সম্প্রতি লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের হাতে ২৬ বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে৷ যেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের কতিপয় অভিবাসন প্রত্যাশী ইউরোপে প্রবেশের উদ্দেশ্য পাচারকারীদের দারস্থ হয়৷ পথিমধ্যে বিবাদ সৃষ্টি সূত্রপাতে পাচারকারীরা ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যা করে।
মানব পাচারকে আমরা মূলতঃ দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ১.পাচারকারী কর্তৃক ফুসলিয়ে/ভয় দেখিয়ে/বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নারী ও শিশু পাচার। ২.উন্নত দেশসমূহে অভিবাসনের লক্ষ্যে জেনে বুঝেও পাচারকারীদের দারস্থ হওয়া।
বর্তমান সময়ে মূলত ২য় প্রকারের পাচারই অত্যধিক পরিমাণে সংঘটিত হচ্ছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কাতার এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনই যাদের মূল লক্ষ্য৷ পথিমধ্যে পাচারকারীদের হাতে অনেকে প্রাণ হারালেও পাচারের সংখ্যা কমছে না। এর মূল কারণ হল দেশের অনুন্নত অর্থনীতি এবং দারিদ্র্যতা।
মানব পাচার সূচকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। যেটা প্রমাণ করে কত অধিক পরিমাণ মানব পাচার প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে।
★আইন কি বলে?
২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে বলা হয়েছে, দ্রুত বিচারের উদ্দেশ্যে সরকার দায়রা জজ বা অতিরিক্তি দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে যেকোনো মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইবুনাল গঠন করতে পারবে। তবে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগ পর্যন্ত সরকার প্রত্যেক জেলার নারী ও শিশু দমন ট্রাইব্যুনালকে এই দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেন। (ধারাঃ২১)
ধারা ২৪এ মামলার বিচার ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। যদি এর মধ্যে শেষ না হয়, তাহলে পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিপোর্ট প্রেরণ করতে হবে। তবে, মামলার বিচারকার্য চলমান থাকবে।
আইনটির ধারা ৩ এ ‘মানব পাচার’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করে প্রতারণা করে বা অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা লেনদেন-পূর্বক উক্ত ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সম্মতি নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোনো শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেওয়াকে মানব পাচার বলা হবে।
এই সংজ্ঞায় কাউকে চাকরী কিংবা কাজের লোভ দেখিয়ে অভিবাসনের জন্য প্রলুব্ধ বা সহায়তা করাকেও মানব পাচার বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
আইনের ১৯ নং ধারায় বলা হয়েছে, মামলার তদন্ত ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে হবে। এবং উপ-পুলিশ পরিদর্শকের নিন্ম পদমর্যাদার কেউ তদন্ত করতে পারবে না। নির্ধারিত সময়ে তদন্ত সমাপ্ত না হওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ কার্যদিবস সময় যুক্ত হতে পারে। এবংকি তদন্তের প্রয়োজনে বিদেশ গমনের অনুমতিও মঞ্জুর করা যেতে পারে।
★শাস্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কেউ মানব পাচার করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে সে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন থেকে সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে পারে (ধারাঃ৬)। আর, সংঘবদ্ধভাবে সংগঠিত হলে প্রত্যেক সদস্য মৃত্যুদন্ড/যাবজ্জীবন থেকে সর্বনিম্ন ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দন্ডিত হবে (ধারাঃ৭)।
আরো বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মানব পাচারের ষড়যন্ত্র করলে শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ সাত বছর ও সর্বনিম্ন তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২০ হাজারা টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে(ধারাঃ৮)।। এবং কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে অন্য কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করাতে বাধ্য করলে বা ঋণদাস করে রাখলে কিংবা হুমকি দিয়ে শ্রম ও সেবা আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ১২ বছরের সর্বনিম্ন ৫ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে(ধারাঃ৯)।
ধারা ১২তে পতিতালয় স্থাপন এবং পরিচালনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের এবং সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া ১৯(৬) ধারায় মামলাগুলো তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল থাকার কথাও বলা আছে। পাচারের শিকার ব্যক্তির পুনর্বাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, পাচারের শিকার ব্যক্তিদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা সেবা, পুনর্বাসন ও পরিবারের সহিত পুনর্মিলনের সুযোগ সৃষ্টিতে সরকার সারাদেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক আশ্রয় কেন্দ্র এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে(ধারাঃ৩৫)।
★৮ বছর পর ট্রাইব্যুনাল গঠন
বর্তমানে বাংলাদেশে ৬ হাজারের অধিক মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু, মানব পাচার সংক্রান্ত স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গত ৮ বছর পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি৷ এই ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে গত ৮মার্চ ময়মনসিংহ ব্যতীত বাকি ৭টি বিভাগে সরকার কর্তৃক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আমাদের আশা এ ট্রাইব্যুনালগুলি জনমনের প্রত্যশা পূরণ করবে এবং মানব পাচার বন্ধ হবে।
Discussion about this post