নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকারের চরম লংঘন এবং একই সাথে একটি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় বাধা। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা খুবই উদ্বেগজনক। মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ গত ১৪ মে ২০০৯ তারিখে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা সম্বলিত রায় প্রদান করেন।
এই রায়ের আলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০ (খসড়া) প্রণীত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১, হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বিষয়ে দায়েরকৃত রিটের রায় প্রদান করেন এবং ১৩ জানুয়ারি ২০১১ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান প্রতিরোধে নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রদান করেন।
এছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ গত ১২ মে ২০১১ তারিখে ফতোয়া সংক্রান্ত একটি রায় প্রদান করেন।
যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আদালতের প্রদত্ত রায় মোতাবেকঃ
১) প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে অভিযোগ বক্স থাকতে হবে;
২) অভিযোগ গ্রহণের জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করতে হবে যার বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী, সম্ভব হলে প্রধান হবেন নারী;
৩) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান তার প্রতিষ্ঠানে সংঘঠিত যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন;
৪) প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
অন্যদিকে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বিষয়ক রায় মোতাবেক ১২ বছরের নীচে কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ না করার বিধান থাকলেও এটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। কোনো নিবন্ধন ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি।
আদালতের নীতিমালাগুলো শুধু নথির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে, বাস্তবে তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। বাস্তবায়নের জন্য নেই কোনো মনিটরিং কমিটি। এই পরিস্থিতিতে বরং নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রায় বাস্তবায়ন না হবার ফলে বাংলাদেশ দেখেছে নাটোরের শিক্ষক মিজানুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, মধুখালীর চাপারানী হত্যাকাণ্ড, হেনার আত্মহত্যা এবং সন্তানসহ মায়ের ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ঘটনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে—
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন এর বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়া টিকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনে পরিণত করা প্রয়োজন;
– মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন এর বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়া (২০১১) টিকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত আইন প্রণয়নসহ মানব পচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন;
– ভিক্টিম – স্বাক্ষী সুরক্ষা আইন এর বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়া টিকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনে পরিণত করে এর দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন;
– ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার ও ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (OCC) এর সেবা তৃনমূল পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হোক। পাশাপাশি সমাজ সেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন আশ্রয় কেন্দ্র গুলোর সেবার মান ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা করা প্রয়োজন;
– মহামান্য আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১০ খসড়া এর আলোকে একটি পূর্নাঙ্গ আইন তৈরি করা করা প্রয়োজন;
– জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এর সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন;
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে Corporal Punishment নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের দেও্য়া রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন;
– পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এর বিধিমালা প্রণয়ন করে আইনটির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন;
– পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধ আইনটির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন;
– ফতোয়া এর নামে বিচার বহির্ভূত শাস্তি প্রদান বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক রায়ের পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন;
এছাড়াও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রণীত প্রচলিত আইন গুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জনগনের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার কে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করা আবশ্যক। একইসাথে আমাদের সকলের সহযোগিতা নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে গুরূত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।
লেখক: অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিক, প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইমেইল: saikotbihr@gmail.com
Discussion about this post