বিডিলনিউজ: দণ্ডিত রাজাকার আবদুল কাদের মোল্লা যে একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে এবং মৃত্যুদণ্ডও চাইতে পারবে। আবার যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে কাদের মোল্লা আপিল করলে, সে ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের আওতায় আপিল বিভাগ সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিসুল হক
প্রচলিত আইনে দণ্ড বাড়ানোর প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিসুল হক বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৩খ ধারায় দণ্ড বৃদ্ধি করতে আপিল আদালতের এখতিয়ার আছে। নিয়ম হলো, আদালত থেকে প্রতিপক্ষকে নোটিশ দিতে হয়। ‘আমি তোমার সাজা বাড়াতে চাই, কেন বাড়াব না, আমাকে বুঝিয়ে দাও’—এই মর্মে আদালতকে একটি রুল জারি করতে হয়। কিন্তু এখানে তা অচল। কারণ, ফৌজদারি কার্যবিধি অকার্যকর। ১৯৭৩ সালের আইনেও দণ্ড বাড়ানোর কথা বলা নেই।
১৯৭৩-এর আইনে এই যে বিধান নেই, সেই সুবিধাটা কে পাবে—আসামিপক্ষ, না সরকার?
উত্তরে আনিসুল হক বলেন, ‘এর সুবিধা আসামিপক্ষ পাবে। তবে প্রশ্ন হলো, সাজা কি বাড়ানো যাবে না? বা বেকসুর খালাসের ক্ষেত্রে সাজা কি দেওয়া যাবে না? এর উত্তরে প্রথম প্রশ্ন হবে, এই মামলার আপিল হবে কোথায়? এটা হবে আপিল বিভাগে। আর আপিল বিভাগ ফৌজদারি কার্যবিধির মতো কোনো আইনের গণ্ডিতে থাকবেন না। এটি একটি সাংবিধানিক আদালত। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আপিল বিভাগ “সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের” জন্য যেরূপ প্রয়োজন, সেরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করতে পারবেন।’
আপিল বিভাগের যে ব্যাপক এখতিয়ার রয়েছে, তার স্বপক্ষে তিনি দুটি রায়ের নজির টানেন। নাজিম উদ্দিন বনাম হামিদা বানু এবং গানিসং বনাম সোনালী ব্যাংক মামলা দুটির রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, তাঁরা ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের’ জন্য প্রয়োজনে যে কারও আপিল আবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘প্রথম দিকে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মনোভাব ছিল, আইনে যেটুকু আছে, তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। কিন্তু অধুনা তাঁরা সেখান থেকে সরে এসেছেন, এখতিয়ার বিস্তৃত করেছেন। তবে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদও স্মরণ রাখতে হবে। এতে বলা আছে, শুধু আইন অনুযায়ী চলতে হবে। তবে আমার মনে হয়, এই মামলার গুরুত্ব বুঝে দণ্ড বাড়ানোর আবেদন করা যেতে পারে।’
আপিল বিভাগ যদি আপিল শুনানিকালে দেখেন, রাষ্ট্রপক্ষ নতুন তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেছে কিংবা তলব করা দলিলপত্রে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গর্হিত অপরাধ সংঘটনের নতুন তথ্য প্রমাণিত হয়েছে, তখনো কি আপিল বিভাগ দণ্ড পুনর্বিবেচনা করতে অপারগ থাকবেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে আনিসুল হক বলেন, ‘আমি রিভিউর কথা বলব না। তবে তাঁরা পুনঃ পর্যালোচনা করতে পারবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের অবশ্যই দায়িত্ব হবে, যেসব তথ্য ও সাক্ষ্য তারা ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছিলেন, সেসব তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষ্যকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা। সে ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আপিল বিভাগ নিশ্চয় তখন তার গুরুত্ব বিবেচনা করে তাঁদের অভিমত দেবেন।’
বেকসুর খালাস আদেশ: আনিসুল হক বলেন, কাদের মোল্লার মামলার রায় থেকে দেখা যায়, মামলা একটি কিন্তু ছয়টি আদেশ নিয়ে একটি রায় হয়েছে। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে একটিতে অপরাধ প্রমাণিত হয়নি বলে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, খালাস দেওয়ার আদেশটি একটি স্বতন্ত্র আদেশ। অন্য পাঁচটির দণ্ডাদেশ থেকে আলাদা।
কিন্তু এর ভিন্ন ব্যাখ্যা কি হতে পারে না?
উত্তরে আনিসুল হক বলেন, ‘এর আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, সেটি হলো, ছয়টি আদেশ নিয়ে সমগ্র বিষয়টি একটিমাত্র রায়। বেকসুর খালাসের আদেশটিও অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু আমার যুক্তি হলো, এখানে কিন্তু বলা হয়নি যে একটি সমগ্র রায় না হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। আইন প্রণেতারা যখন বলছেন একটি বেকসুর খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে, তখন তাঁরা এর অর্থ নিশ্চয়ই বেকসুর খালাস অর্থে ব্যবহার করেননি।
কিছু দরকারি বিষয় নেই: প্রসিকিউশনের দুর্বলতার অভিযোগ সম্পর্কে আনিসুল হক বলেন, ‘রায় পড়ে মনে হয়েছে সেখানে কিছু দরকারি বিষয় নেই। আর সেটা উপলব্ধি করা এবং তা সরবরাহ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের ছিল।’ বিচারকদের ভূমিকা-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখানে আদালত বোবা। আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে রক্ষা করতে পারে না। তাই ট্রাইব্যুনাল তাঁর দায়িত্ব পালন করেননি বলাটা অন্যায় হবে।’
সশ্রম: আগে যাবজ্জীবনের মেয়াদ ১৪ বছরের দ্বীপান্তর ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এটা প্রথমে বাড়িয়ে ২০ বছর এবং ১৯৮৫ সালে ৩০ বছর করা হয়। আনিসুল হক বলেন, যাবজ্জীবন মানেই সশ্রম কারাদণ্ড। এটা বিনাশ্রম হয় না। তাই সশ্রম কারাদণ্ডের কথা রায়ে উল্লেখ নেই। তবে জেল কোড অনুযায়ী দেখা গেছে, এই ৩০ বছরের সাজা কমপক্ষে সাড়ে ২২ বছর হয়। এর অর্থ এই নয় যে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কেউ এর বেশি ভোগ করেন না। জেলখানার বছর নয় মাসে হয়, এমন কথা জেল কোডে আমি পাইনি। অনেক দুষ্ট লোককে প্রায় ৩০ বছরই খাটতে হয়। কাদের মোল্লা দুষ্ট হলে অনধিক ৩০ বছরই জেল খাটবেন।
আপিলের সীমা সম্পর্কে আনিসুল হক বলেন, সরকার ও আসামি উভয় পক্ষকে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। রায়ের সার্টিফায়েড কপি চূড়ান্ত হওয়ার তারিখ থেকে ৩০ দিনের গণনা শুরু হবে।সূত্র:প্রথম আলো
Discussion about this post