ফারহান তাম্বীরুল হক:
সংসদীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র জাতীয় সংসদ । সংসদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। প্রাণবন্ত আলোচনা ও যুক্তি-তর্কে প্রণীত হয় আইন । জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আর সরকারের এুটি বিচ্যুতি তুলে ধরতে সংসদে কথা বলার চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন মাধ্যম নেই ।
সংসদকে কেন্দ্র করেই সুস্থ ধারার রাজনীতি বিকশিত হয় । গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হল কার্যকর ও গতিশীল সংসদ । পার্লামেন্টের আলোচনা , সমালোচনা , যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে উঠে আসে জনগণের নানাবিধ সমস্যা আর সেগুলো সমাধানের সম্ভাব্য পন্থাগুলো ।
কিন্তু এ সকল কিছু কার্যকর করতে হলে প্রথমত যেটি দরকার তা হল সংসদের অধিবেশনে সকলের অংশগ্রহণ । ঠিক এই জায়গাটিতেই বাংলাদেশের সংসদ ও সংসদীয় রাজনীতি থমকে আছে ।
সংসদে যাবার ব্যাপারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরাবরই অনীহা লক্ষ্য করা গেছে । সংসদে সময় দেবার ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের আগ্রহ চোখে পড়ার মত নয় । বাংলাদেশের প্রথা হল বিরোধী দলে থাকলে সংসদ বর্জন করা । সংসদবিমুখ বিরোধী দল রাজপথে কর্মসূচী দেবার ব্যাপারে বেশি উৎসুক থাকে ।
অপরদিকে সরকারি দলে থাকলে সংসদ বর্জনের নিন্দা জানানো হয় এবং বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলার আহবান জানানো হয় । বিরোধী দল থেকে বলা হয় সংসদে যাবার পরিবেশ নেই । মাঝে মাঝে সদস্যপদ রক্ষার জন্য দু’ এক মিনিটের জন্য সংসদে যাবার ঘটনাও বিরল নয় । বিরোধীদল বিহীন নিরুত্তাপ সংসদে নেতা-নেত্রীর বন্দনায় দীর্ঘ সময় ব্যয় করা হয় । এভাবেই চলছে আমাদের সংসদীয় কার্যক্রম ।
প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সংসদকে কার্যকর ও সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় । কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় না । নিজ এলাকার জণগনের জন্য কথা বলার জন্যই সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয় । অথচ নির্বাচিত হবার পর শুরু হয় সংসদ বর্জনের পালা ।
সংসদ অধিবেশনে অংশ না নিলেও প্রতি মাসে বেতন ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি ঠিকই গ্রহণ করা হয় । এমনকি স্থায়ী কমিটির সভাগুলোতে নিয়মিত যোগ দিলেও অধিবেশন কক্ষে যান না অনেক সংসদ সদস্য । বলা বাহুল্য সংসদ সদস্যদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি বাড়ানোর পরও সংসদ অধিবেশনে উপস্থিতি হতাশাজনক ।
তাই এখন দাবী উঠেছে আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করার ।
সংবিধানের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিতির সুযোগ থাকায় বিরোধীদল অবিরাম সংসদ বর্জন করছে।
পঞ্চম সংসদে বর্জনের হার ছিল ৩৪ শতাংশ, যা নবম সংসদে এসে ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি টিআইবি আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করার সুপারিশ করেছে । জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উদযাপনের অংশ হিসাবে টিআইবি ‘সংসদীয় উন্মুক্ততার ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ উপলক্ষে এ প্রস্তাব দেয়। টিআইবির সুপারিশে বলা হয়েছে, সংসদ কার্যকর ও গণমুখী করা এবং সংসদের মালিকানায় জনগণের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিদ্যমান আইন ও চর্চাকে ঘোষণাপত্রের আলোকে সংগতিপূর্ণ করতে হবে।
জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য সংসদের কার্যবিবরণী এবং সাংসদদের আয় ও সম্পদের বিবরণী নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করা, আইন প্রণয়ন ও সংসদীয় কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করে তা সহজলভ্য করার কথাও সুপারিশে বলা হয়েছে। প্রস্তাব তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের মতো সংসদ বর্জনের দৃষ্টান্ত বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই।
টিআইবি আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করা এবং দলগতভাবে সংসদের অধিবেশনে যোগদান থেকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন বিরত থাকার রীতি, যার মধ্যে একাধারে সাতদিনের বেশি অনুপস্থিত থাকা যাবে না- এরূপ বিধান প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছে । এছাড়াও সংসদ সদস্যদের আচরণবিধিকে আইনে রূপান্তরের উপর জোর দেওয়া হয় ।
জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে সংসদকে কার্যকরের স্বার্থে আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করা চিন্তা করার সময় এসেছে ।
লেখক: স্টুডেন্ট, আইনবিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post