নিজস্ব প্রতিবেদক: তিন কোটি সাত লাখ টাকার সম্পদ গোপন এবং তিন কোটি ২৮ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পুলিশের বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমান, তাঁর স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্না, ভাই মো. মাহবুবুর রহমান ও ভাগ্নে মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এ মামলাটি থানা বা আদালতে নয়, দুদক বিধিমালা সংশোধনের পর দুদকের প্রধান কার্যালয়েই করা হয়েছে। দুদক কার্যালয়ে করা এটিই প্রথম মামলা।
গতকাল সোমবার সেগুনবাগিচায় দুদকের ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয় কার্যালয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলা হওয়ার পর আসামিরা গাঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে ডিআইজি মিজানকে শিগগিরই সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল নামে-বেনামে আত্মীয়স্বজনের নামে ফ্ল্যাট, জমিসহ সম্পত্তি কেনা হলেও কৌশলে ডিআইজি মিজানই এসবের মালিক এবং দখলদারিতে রয়েছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, মামলার পরপরই আসামিদের গ্রেফতারে দুদকের তদন্ত টিম মাঠে নেমেছে। গ্রেফতার এড়াতে ডিআইজি মিজান এরই মধ্যে নিজের বাসস্থান থেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে দুদকের সূত্র জানিয়েছে। মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তাঁর অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, যেখানেই পালিয়ে থাকুক না কেন, অবশ্যই তাঁকে দুদকের জালে আটকানো হবে।
এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধানদল ডিআইজি মিজান এবং তাঁর স্বজনদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করে। প্রতিবেদনে মিজানের ঢাকা ও বরিশালে একাধিক ফ্ল্যাট, জমি, গাড়ি-বাড়িসহ অঢেল সম্পত্তির তথ্য-প্রমাণাদি উল্লেখ করা হয়। গত রবিবার কমিশনের বৈঠকে যাচাই-বাছাই শেষে মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়। দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল ওই অনুসন্ধান চালায়। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিক ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল আহাস গাজী।
অন্যদিকে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে সদ্য বরখাস্ত হওয়া দুদক পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা এনামুল বাছিরকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে পৃথক একটি দল অনুসন্ধান চালাচ্ছে। মিজান ও বাছিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামী ১ জুলাই দুদক কার্যালয়ে হাজির হতে গতকাল নোটিশ জারি করা হয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদবলেন, অনুসন্ধান প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা যাচাই-বাছাই শেষে মামলার অনুমোদন দিয়েছি। বিধিমালা সংশোধনের পর এই প্রথম মামলাটি কমিশনের দপ্তরেই করা হয়েছে। এখন আইন অনুযায়ী দুদকের অনুসন্ধান কিংবা তদন্তদল পুরোপারি স্বাধীন। তারা তাদের মতো করেই কাজ করবে, এ ক্ষেত্রে আমর কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই।
মিজানের অবৈধ সম্পদ সম্পর্কে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসামি মো. মিজানুর রহমান ভাগ্নে পুলিশের এসআই মাহমুদুল হাসানের নামে গুলশান-১-এর পুলিশ প্লাজা কনকর্ডে ২১১ বর্গফুট আয়তনের একটি দোকান কিনে তাঁর স্ত্রী সোহেলিয়া আনারের নামে ভাড়া দেখিয়ে নিজ দখলে রাখেন। মিজান নিজে নমিনি হয়ে তাঁর ভাগ্নে মাহমুদুলের নামে কারওয়ান বাজার শাখার ওয়ান ব্যাংকে ৩০ লাখ টাকা জমা করেন। দুদক অনুসন্ধানে নামার পর সুদে-আসলে ৩৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উঠিয়ে নেন মিজান। একইভাবে তাঁর ভাই মাহবুবুর রহমানের নামে বেইলি রোডে দুই হাজার ৪০০ বর্গফুটের প্রায় এক কোটি টাকার ফ্ল্যাট কেনেন। দুদকের অনুসন্ধানে মাহবুবুর রহমান ফ্ল্যাট কেনার বৈধ আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি। ওই ফ্ল্যাটটি এখন ডিআইজি মিজানের দখলে রয়েছে। আর মিজানের স্ত্রী সোহেলিয়ার নামে কাকরাইলের পাইওনিয়ার রোডে ‘নির্মাণ সামাদ ট্রেড সেন্টারে’ ১৭৭৬ বর্গফুটের একটি দুই কোটি টাকা মূল্যের বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট আছে। এভাবে আসামি মিজানুর রহমান ঘুষ ও দুর্নীতির টাকায় নিজের নামে না নিয়ে স্ত্রী, ভাই ও ভাগ্নের নামে তিন কোটি সাত লাখ পাঁচ হাজার ৪২১ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনপূর্বক তা গোপন করেছেন। এরই মধ্যে মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত দুদকের অনুসন্ধানদলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডিআইজি মিজানসহ আসামিদের নামে করা স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক এবং ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন।
এদিকে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ডিআইজি মিজানুর রহমান ও দুদকের বরখাস্তকৃত পরিচালক এনামুল বাছিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক দল। গতকাল দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো তলবি নোটিশে তাঁদের ১ জুলাই হাজির হতে বলা হয়েছে। দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্ল্যার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছে। দলের অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।
ডিআইজি মিজান দুদকের আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা, পরিচালক এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেন বলে অভিযোগ ওঠে। গণমাধ্যমে বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পরপর এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ডিআইজি মিজানের কর্মকাণ্ডের প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী, পরে এ দায়িত্ব পান এনামুল বাছির। এখন অনুসন্ধান কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন আরেক পরিচালক মো. মঞ্জুর মোর্শেদ।
এ ছাড়াও ডিআইজি মিজানকে শিগগিরই সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। তবে তাঁকে গ্রেফতারে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রসচিব (জন নিরাপত্তা বিভাগ) মোস্তাফা কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা নেই। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে। বিভাগীয় মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা হয় না।’ প্রসঙ্গত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্প্রতি বলেছেন, আইনের ফাঁকে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না ডিআইজি মিজান।




Discussion about this post