কাজী হেলাল উদ্দিন
প্রাচীনকালের বঙ্গ জনপদ পরবর্তীকালে বঙ্গদেশ নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমান বাংলাদেশের চেয়ে প্রাচীন বঙ্গ জনপদ অনেক বড় ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে বাংলার যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তখন মৌর্য রাজবংশ বঙ্গ শাসন করতেন। পরবর্তিতে গুপ্ত, পাল, সেন রাজবংশ, মুসলিম এবং বৃটিশরা এ অঞ্চল শাসন করতেন। প্রাচীন কালে রাজ্যের রাজা নিজেই বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। রাজার আদালত ছিল রাজ্যের প্রধান আদালত। রাজার আদেশ তখন সবাই আইন হিসাবে মান্য করতেন।অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ ও মন্ত্রীমন্ডলী রাজার আদালতে বিচার কাজে সাহায্য করতেন। প্রাচীন বাংলায় প্রত্যেক গ্রামের জন্য একজন গ্রাম প্রধান থাকতেন। গ্রাম প্রধান গ্রামের মানুসের মধ্যকার বিরোধ মিমাংসা করতেন। গ্রাম প্রধান বিরোধ নিস্পত্তিতে অপারগ হলে গ্রাম পঞ্চায়েত ঐসব বিচার নিস্পত্তি করতেন। বিচার কাজে বয়জ্যেষ্ঠ্য, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সাহায্য করতেন। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিচার প্রার্থীদের পরামর্শ দিতেন। পরামর্শের জন্য তাঁরা ফি গ্রহন করতেননা, তবে উপঢৌকন গ্রহন করতেন। তখন আইন পেশা বা আইনজীবীদের কোন প্রতীষ্ঠান ছিলনা। মুসলমান শাসনামলে বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। তখন মামলার পক্ষরা তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করার জন্য উকিল নিয়োগ করতে পারতেন।
তখন মামলার পক্ষরা উকিলের পারিশ্রমিক দিতেন। কোন পক্ষ দারিদ্রের কারণে পারিশ্রমিক দিতে না পারলে, বিনা পারিশ্রমিকে অনেকে ওকালতি করতেন। তখনো উকিলদের সনদ দেওয়ার বিধান গড়ে ওঠেনি । ১৭৭৪ খ্রিঃ রাজকীয় সনদের বলে কলিকাতায় সুপ্রীমকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সনদের ১১ নং অনুচ্ছেদে কলিকাতা সুপ্রিমকোর্টকে অ্যাডভোকেট ও অ্যটর্নীদের সনদ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। উক্ত সনদ ছাড়া আদালতে কেউ মামলা পরিচালনা করতে পারতেন না। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবীদের সনদ বাতিল করতে পারতো।
১৭৫৭-১৮৫৬ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতবর্ষে কোম্পানী শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতবর্ষে তাদের অধিকৃত এলাকায় বিচারাদালত গুলিতে কোম্পানী কর্তৃক বিচারক নিযুক্ত করতে থাকেন। ১৭৯৩ সনের চার্টার আইন অনুযায়ী সদর দেওয়ানী আদালত উকিলদের সনদ দিতে পারতো। শিক্ষিত সত্, হিন্দু ও মুসলিম আইনজ্ঞদেরকে সদর দেওয়ানী আদালত বা কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত অধঃস্তন আদালতে মামলা পরিচালনার সনদ দিত। সনদ প্রাপ্ত উকিল মক্কেলদের নিকট থেকে পারিশ্রমিক গ্রহন করতে পারতেন। ওকালতিতে অসদাচরণ বা অন্য কোন অভিযোগে অভিযুক্ত উকিলকে আদালত যে কোন সময় বরখাস্ত করতে পারতেন। ঐ আদালত নিম্ন আদালত হলে, ঐ আদালতের প্রতিবেদন অনুযায়ী সদর দেওয়ানী আদালত অভিযুক্ত উকিলের সনদ বাতিল করে দিতে পারতেন। তবে সনদ বাতিল প্রক্রিয়ায় উকিলের আত্ম পক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিলনা। আদালতের সামনে উকিল ছিলেন অসহায়। সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনা করার জন্য সরকারী উকিল নিয়োগ করার বিধান তখন থেকে চালু হয়। ঐ আইন অনুযায়ী কেবলমাত্র হিন্দু ও মুসলমানদের ওকালতি সনদ দেওয়া হত। হিন্দু ও মুসলিম আইনের জ্ঞান থাকা ওকালতি সনদ প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত ছিল।
১৮৩৩ সনের চার্টার আইন অনুযায়ী উকিলদের সনদ দেওয়া সম্পর্কিত বিধানের কিছুটা সংশোধন করে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে যে কোন আইনজ্ঞ ব্যক্তিকে সদর দেওয়ানী আদালত ওকালতি সনদ দিতে পারতো। তখন থেকে সদর দেওয়ানী আদালতের উকিলদের তাদের মক্কেলদের নিকট থেকে গ্রহনীয় ফি নির্ধারন করার অধিকার দেওয়া হয়। ১৮৪৬ সনের ৭ জানুয়ারী, দি লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যাক্ট, ১৮৪৬ সনের ১ নং আইন পাশ হয়। উক্ত আইনের ৪ নং ধারায় জাতী ধর্ম নির্বিশেষে যে কোন ব্যক্তিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীন যেকোন আদালতে ওকালতি সনদ দেওয়ার বিধান করা হয়। সদর আদালতকে সনদ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়।১৮৪৬ সনের আইনজীবী আইনের ৫ নং ধারা অনুযায়ী ব্যারিস্টারদেরকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীন যেকোন আদালতে মামলা মক্কেলের পক্ষে পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়। উক্ত আইনের ৭ নং ধারা অনুযায়ী মামলা পরিচালনার জন্য উকিলদের ফি নিরধারন করার বিধান রাখা হয়। ১৮৪৬ সনের আইনজীবী আইনের ৯ ধারানুযায়ী উকিলদের আইনের পরামর্শ গ্রহনের জন্য মক্কেলদের নিকট থেকে ফি গ্রহনের অধিকার দেওয়া হয়। উকিলের বিরুদ্ধে কোন অসদাচারণ বা অন্য কোন অভিযোগের কারণে সদর আমিন আদালত ইকিলদের অর্থদন্ড দিতে পারতেন। সদর আমিন আদালতের উক্তরূপ দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে জেলা আদালতে আপীল করা যেত । ১৮৫৩ খ্রিঃ সনের ২০ নং আইন দ্বারা ১৯৪৬ সনের আইনজীবী আইনের আরো কিছু সংশোধন করা হয়। ঐ আইনের ২ ধারায় বলা হয়, “Pleader not bound to attend court except at hearing of cause in which he is employed.” ঐ আইনের ৩ ধারা বলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীকে, ইষ্ট ইন্ডিয়াকোম্পানীর যে কোন আদালতে মামলা পরিচালনা করার অধিকার দেওয়া হয়।
দি লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যাক্ট ১৮৭৯ (১৮৭৯ সনের ১৮ নং আইন), ১৮৭৯ সনের ২৯ অক্টোবর পাশ হয় এবং ১৮৮০ সনের ১ জানুয়ারী থেকে কার্যকর হয়। এই আইটি ছিল আইন পেশাজীবীদের জন্য অত্যন্ত ভাল একটি আইন। এই আইনে অ্যাডভোকেট, ভেকিল ও অ্যটর্নীদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয় ও মামলা পরিচালনার অধিক্ষেত্র নিদ্দৃস্ট করা হয়। ঐ আইনের ৩য় অধ্যায়ে ৬ নং ধারায় উকিল ও মুক্তারদের সনদ প্রাপ্তির যোগ্যতা ও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্র নির্ধারন করা হয়। ঐ আইনের ৩ ধারায় লিগ্যাল প্রাকটিশনারের সংগা দেওয়া হয়। এই আইনের ৬ ধারায় হাই কোর্টকে উকিল ও মুক্তারদের সনদ প্রপ্তির যোগ্যতা নির্ধারন ও নিদ্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে ওকালতি সনদ প্রদানের জন্য পরীক্ষার বিধান করা হয়। হাই কোর্টকে উকিল বা মুক্তারদের সনদ বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়। উক্ত সনদ একটি নিদ্দৃিষ্ট সময়ের জন্য ইস্যু করা হত এবং জেলা আদালতের জজের অনুমোদনের মাধ্যমে নবায়ন করা হত। সনদ প্রদানকারী হাই কোর্টের অধিক্ষেত্রের সকল অধস্তন আদালত ও রাজস্ব অফিসে উক্ত সনদধারী উকিল বা মুক্তারগণ মামলা পরিচালনা করতে পারতেন। উক্ত আইনের ১২ ধারায় ফৌজদারী অপরাধে দন্ডিত আইনজীবীর সনদ সাময়িক স্থগিত বা বাতিলের বিধান রাখা হয়। আইনজীবীদের বরখাস্তের উক্ত আদেশ হাই কোর্ট বাতিল করতে পারতো। এই আইনের ২৭ ধারায় উকিল, মুক্তার ও এবং রাজস্ব অফিসারদের ফি নির্ধারনে হাই কোর্টকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৮৭৯ সনের আইনজীবী আইনের ৩২ ধারায় সনদ ছাড়া কেউ ওকালতি করলে ৬ মাসের দেওয়ানী কারাবাসের শাস্তি নির্ধারন করা হয়। ২৬ ধারানুযায়ী কোন আইনজীবীদের অসদাচরণের জন্য বরখাস্ত করা হলে উক্ত আইনজীবীকে সনদ জমাদিতে হতো। বরখাস্ত বা সনদ বাতিল হওয়া আইনজীবী আদালতে মামলা পরিচালনা করলে ৬ মাসের দেওয়ানী কারাবাসের নিয়ম করা হয়। ৩৭ ধারানুযায়ী সরকার সময়ে সময়ে ওকালতির সনদ প্রদানের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
১৮৮৪ সনের ৯ নং আইন করার মাধ্যমে ১৮৭৯ সনের আইনজীবী আইনের কিছু সংশোধন করা হয়। ১৮৮৪ সনের আইনে উকিলদের বরখাস্ত বা সনদ বাতিলের পূর্বে আইনজীবীর বক্তব্য প্রদান ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা হয়। ১৮৮৯ সনে ঢাকা আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন যায়গায় আইনজীবী সমিতি গড়ে ওঠে।
১৮৯৮ সনের ১১ নং আইন দ্বারা ১৮৭৯ সনের আইনজীবী আইনের আরো কিছু সংশোধনী আনা হয়।
তখন পর্যন্ত আইন পেশায় নারীরা অংশ গ্রহন করতেন না। তবে কর্নেলিয়া সরাবজী প্রথমে নারী ১৮৯৯ সনে সনদ লাভ করেন। তবে নারীরা তখন এই পেশায় আসতেন না।নারীদের আইনপেশায় আসার কোন আইনগত বাধা না থাকলেও সামাজিক কারণে নারীরা আইনপেশায় আসতেন না। নারীরা আইনপেশায় আসবেনকিনা তানিয়ে সংশয় ছিল। এই সংশয় দুর করার জন্য নারী আইনজীবী আইন ১৯২৩ পাশ হয়। ঐ আইনের ৩ ধারায় বলা হয় কোন নারী শুধুমাত্র নারী এই কারনে আইনজীবী হিসাবে অযোগ্য করা যাবে না।
১৯২৬ সনে পাশ হয় আইনজীবী ফি আইন। এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়, উকিল কোন ব্যক্তির সাথে পেশাগত কোন কাজে সম্মত হলে, তিনি ঐ ব্যক্তির সাথে আলোচনা করে স্বাধীনভাবে ফি নির্ধারন করতে পারবেন।
the Indian Bar Council Act (১৯২৬ সনের ৩৮ নং আইন) পাশ হয় ১৯২৬ খ্রিঃ সনে। এই আইনটির মাধ্যমে আইন পেশার এক অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও পরিবর্তন সাধিত হয়। বার কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে, আইন পেশার সনদ দানের ব্যবস্থা করা হয়। বিচারক ও আইনজীবীদের একটি কমিটি বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী আইনজীবী সনদ প্রদান শুরু করে। আইনজীবীদের ভোটে আইনজীবীদের মধ্য থেকে।, বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচনের বিধান রাখা হয়১৯৪৭ সনে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃস্টি হলে উভয় রাষ্টিরেই বৃটিশ ভারতের বিচার ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখে। ১৯৬৫ সনে দি লিগ্যাল প্রাকটিশনার অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্ট অনুযায়ী পাকিস্তানের সকল প্রদেশে বার কাউন্সল গঠন করা হয়।
১৯৭১ সনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর The Legal Practitioners and Bangladesh Bar Council Act 1972, P O No. – 46 of 1972 অনুযায়ী বাংলাদেশ বার কাউন্সিল গঠন করা হয়। বর্তমানে বংলাদেশের আইন পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদশ বার কাউন্সিল।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
Discussion about this post