পৃথিবীর সর্বত্রই আইন পেশা একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে স্বীকৃত। একে Royal Profession বলা হয়। এই আইন পেশার মানুষকে ‘সমাজ কৌশলী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, সমাজের নানা বিষয়ে অসংগতি ও বৈষম্য দূর করতে একজন আইন পেশাজীবীকে রাখতে হয় অগ্রগামী ভূমিকা। তাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আইন পেশা স্বীকৃত হয়ে আসছে সম্মান ও ঐতিহ্যের পেশা হিসেবে।আমাদের দেশেও একজন সৎ অ্যাডভোকেট এর পেশাগত মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চে। অতি সম্মানের নিদর্শন স্বরূপ একমাত্র ‘অ্যাডভোকেট’ ও ‘বিচারক’ শব্দের পূর্বে ‘Learned’ বা ‘বিজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
লর্ড ম্যাকমিলানের মতে “অন্য কোন পেশা মানবজীবনকে এত স্পর্শ করে না।” একজন অ্যাডভোকেট তার অবস্থানের প্রেক্ষিতে আদালতে অফিসার এবং বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ও তার মক্কেলকে পেশাগত উপদেশ প্রদানের জন্য জনসাধারণের ওপর তার প্রভাব অত্যন্ত প্রখর। আর এ প্রভাবের কারণেই ভালো হোক অথবা মন্দ হোক যে কোন কাজই সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির চেয়ে একজন আইনজীবীর কর্মকাণ্ড, দৃষ্টান্ত ও আর্দশ সমাজের ওপর অনেক বেশি কার্যকর।
অ্যাডভোকেটগণ আদালতে বিনীতভাবে সততার সাথে তার মক্কেলের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিচারককে সরাসরি সহায়তা প্রদান করেন বিধায় অ্যাডভোকেটগণ আইন আদালতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
অসংখ্য মৌলিক আইন গ্রন্থের প্রণেতা মরহুম গাজী শামসুর রহমান বলেন, কোন মানুষ ভ্রমের ঊর্ধ্বে নয়, সম্ভবত বিচারকও নয়। বিচারকের ভ্রম ধরিয়ে দিতে পারে শুধু সেই ব্যক্তি যিনি জ্ঞানে, গুণে, মর্যাদায় এবং অবস্থানে বিচারকের সমকক্ষ। সেই ব্যক্তিই অ্যাডভোকেট।
আদালতের ক্ষমতা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে বিচারকগণ যেমন কতিপয় বিশেষাধিকার ভোগ করেন, আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্যগণও তেমনি কতিপয় বিশেষ অধিকার ভোগ করার অধিকারী।
প্রচলিত আইনে এবং বিভিন্ন নজিরসমূহ থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটগণ আদালত অঙ্গনে যেসব বিশেষাধিকার ভোগ করেন তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলো :
বিচারক কর্তৃক অ্যাডভোকেট এর অবমাননা আদালত অবমাননার শামিল:
আইন অ্যাডভোকেট এর সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে কতটুকু সচেষ্ট তা নিম্নের নজিরসমূহ থেকে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করা যাবে।
একজন অ্যাডভোকেট যখন তার মক্কেলের মামলা পরিচালনা করেন, তখন যদি আদালত অর্থাৎ বিচারক তার (অ্যাডভোকেটের) আচরণ নিয়ে মন্তব্য করেন, তবে আদালত অবমাননার (Contempt) অপরাধ হতে পারে। (৩৫সি, ডব্লিউ, এন ১৮৯= ৫৮সি ৮৮৪=১৯৩১ ক্যাল ২৫৭=১৯৩১ ক্যাল; ১৫সি, ডব্লিউ, এন- ১৮৯=১৯১৩ ক্যাল ২৫৭= ৫৮ ক্যাল ৮৮৪)।
যদি আদালত কোন মোকদ্দমা শুনানিকালে পুলিশ গার্ড ডাকেন এবং কোন যথার্থতা ছাড়াই আইনজীবীকে আদালত কক্ষ হতে বের করে দেন তবে তা আদালত অবমাননার শামিল। (Prag Das Advocate V.Sir P.C. Agrwal’1975 ALI .L.J.41; 1975 Cr. L. J. 659)
উচ্চ আদালতের স্থগিত আদেশের বিষয়ে অ্যাডভোকেট কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র (Lawyer Certificate) কোন আদালতে দায়ের হলে সে আদালতের উচিত উক্ত প্রত্যয়নপত্র (Lawyer Certificate) অনুযায়ী মোকদ্দমা স্থগিত করা। কারণ অ্যাডভোকেট আদালতের একজন অফিসার এবং ঐ প্রত্যয়নপত্রের (Lawyer Certificate) দায়-দায়িত্ব তিনি বহন করেন। অ্যাডভোকেটের প্রত্যয়নপত্রে (Lawyer Certificate) প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা নিরূপণের চেষ্টা না করে তাকে অবিশ্বাস বা নাকচ করে দেয়া আদালত অবমাননার অপরাধ হবে।(Harikishan Sing V. Chhotan Mahton) AIR 1951 Pat. 490; 1951 (Vol. 52) Cr. LJ, 638]
অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নাম রটানো, অপমান করা যাবে না :
অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে তার মোকদ্দমা পরিচালনার ব্যাপারে মিথ্যা দুর্নাম রটানো যা তাকে এ মোকদ্দমা পরবর্তী পরিচালনা করতে বিব্রত করে তা আদালত অবমাননা হিসেবে চিহ্নিত হবে। (Anantalal Singha V. Alfred Henry Watson (1930) 58 Cal. 884.
বিচারাধীন মামলায় আইনজীবী যাতে তার দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তজ্জন্যে অ্যাডভোকেটকে অপমান করা আদালত অবমাননা। (Thirumalaippa V. Kumaraswami, AIR 1956
Mad. 621 (1956) I. L.R. Mad. 1239)
অ্যাডভোকেটগণ যে সকল বিচার বিভাগীয় বিশেষ সুবিধা ভোগ করার অধিকারী:
মামলা চলাকালীন সময় অ্যাডভোকেটগণ বিবৃতি বিশেষ সুবিধার অন্তর্গত। তার এ অধিকার নিম্নবর্ণিত নীতিমালা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১। কোন আইনজীবী যখন কোন মামলা পরিচালনা করেন তখন তিনি নিরংকুশ বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন।
২। যদি কোন অ্যাডভোকেট বিশ্বস্ততার সাথে মামলা চলাকালে মানহানিকর বিবৃতি দেন তার জন্য তিনি দায়ী হবেন না।
৩। তার বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা যাবে না।
৪। মামলা চলাকালে অ্যাডভোকেট যদি বাদীকে মিথ্যাবাদী ও ধাপ্পাবাজ বলেন তাহলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
৫। যদি কোন অ্যাডভোকেট মামলা চলাকালে সাক্ষীকে বদমাশ বা লম্পট বলে, তাহলেও তার বিবৃতিটিকে বিশেষ সুবিধার অধীন বলে ধরে নেয়া হবে।
অতএব কোন অ্যাডভোকেটকে তার আইনবিষয়ক কাজে বা মামলা চলাকালে প্রাসঙ্গিকভাবে মানহানিজনক বিবৃতি প্রদানের জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। তিনি যাই বলুন না কেন, তা প্রকৃত সত্য নাও হতে পারে বা অতিরঞ্জন হতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সুবিধা ভোগ করবেন।
আদালতে অ্যাডভোকেটের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এক্সপাঞ্জ (Expunge) করতে হবে:
বিচারাধীন মামলায় একজন আইনজীবী তার মক্কেলের পক্ষে আইনের যুক্তিতর্ক পেশ করার প্রাক্কালে সম্পূর্ণভাবে আইনের স্বাধীনতা পেয়ে থাকেন এবং এজন্যে ঐ সময় যদি সংশ্লিষ্ট মামলাটির “MERIT” বা গুণাগুণের সাথে সম্পর্কহীন এমন কোন মন্তব্য করা হয় যা ঐ মামলা সংক্রান্ত নহে বরং সম্পূর্ণরূপে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর পেশাগত চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কিত, তাহলে ঐ জাতীয় মন্তব্য আদালত প্রদত্ত রায়ের অংশ হিসেবে রেকর্ডে রাখা যাবে না এবং তা রেকর্ড হতে মুছে (Expunge) ফেলতে হবে। (১৯৭৯) ৩১ ডি, এল,আর (এ.ডি) ১৬৩।
অ্যাডভোকেটের অধিকার অলংঘনীয়:
কোন মূল মোকদ্দমার বিচার কার্য (tiral) অথবা কোন আপিলের শুনানিকালে মোয়াক্কেলের নিয়োজিত আইনজীবীর নীতিমালায় অধিকার লংঘনীয় বা “indefeasible” এবং তা কোনমতেই লংঘন করা যাবে না। কারণ এটা প্রাকৃতিক বিচারের নীতিমালার একটি সার্বজনীন বিধান যা অস্বীকার করলে প্রদত্ত রায়টি অকার্যকর হয়ে যাবে। (৬ ডি, এল, আর ৬৫ (এস, সি)
আদালতের ওপর আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপট তুলে ধরার অধিকার:
কোন মক্কেলের পক্ষে ন্যায়বিচার না পাওয়ার ব্যাপারে আদালতের ওপর আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপট তুলে ধরার অধিকার তার নিযুক্তীয় আইনজীবীর রয়েছে। M.H. Khondoker V. State (1960)
D.L.R. (SC) 124.
আইনজীবীর প্রতি হুমকি প্রদর্শন আদালত অবমাননা:
মোকদ্দমার কোন পক্ষ অপর পক্ষের আইনজীবীর প্রতি হুমকি প্রদর্শন করলে আদালত অবমাননা হবে; কারণ এটা বিচার কার্যে বাধার শামিল। State V. Abdul Aziz P.L.D (1962)
Lahore, 335.
পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে আইনজীবীকে দায়ী/অভিযুক্ত করা যায় না:
(1993) 13BLD (AD)152-
Supreme Court, High Court Division, জাস্টিস মুহাম্মদ আনছার আলী ও জাস্টিস কাজী এবাদুল হক এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। মিসেস সিগমা হুদা এডভোকেট বনাম ইসফাক সামাদ এবং অন্যান্য মামলায় মহামান্য আদালত বলেন, ‘‘Imputations, if made by a lawyer in the discharge of his or professional duty on the character of any person in good faith, whether will constitute any offence of defamation- A lawyer while acting under the instructions of his or her client, whether has a qualified privilege- An Advocate whether is entitled to special protection.’’
একজন আইন উপদেষ্টা তার আইনগত অভিমতের জন্য দায়ী নহেন:
এ প্রসঙ্গে মহামান্য (HCD) উচ্চ আদালতের জাস্টিস মোঃ মোজাম্মেল হক এবং জাস্টিস মোঃ নুরুল ইসলাম কর্তৃক আব্দুস সামাদ বনাম রাষ্ট্র মামলার [BLC (1996) page 63] জাজমেন্টে বলেন, “A Legal Adviser cannot be made liable for the offence of forgery and criminal breach of trust for giving his legal opinion”
আদালত অঙ্গন থেকে আইনজীবী গ্রেফতার:
আইনজীবী কর্তৃক মামলা পরিচালনারত অবস্থায় পুলিশ অফিসার কর্তৃক ইশারা দিয়ে ডেকে নিয়ে তাকে গ্রেফতার করা এবং হ্যান্ডকাপ দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া গুরুতর অবমাননা। (রাজশাহী বার কাউন্সিল-বনাম-নাথুরাম, এ, আই, আর ১৯৫৬ রাজ: ১৭৯ (১৮৪): আই, এল,আর (১৯৬৬) ৬ রাজ: ৯৬৪, ১৯৫৬ সিআর,এল, জে ১৩৫০ (বিডি)। উদ্দেশ্যমূলকভাবে এবং বিচারকার্যে বাধা সৃষ্টির বা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করার জন্য হাইকোর্টে উপস্থিত হওয়ার জন্য যাওয়ার সময় পুলিশ অফিসার কর্তৃক আইনজীবীকে গ্রেফতার করলে তা আদালত অবমাননার অপরাধ। শুধুমাত্র ভুলবশত এবং সততাপরায়ণ গ্রেফতার অবমাননা হবে না। (Home Rustomji V. Sub-Inspector Baig, AIR 1944 Lah 196 (199-200) 46 cr.LJI (S.B)
‘আদালত’ বলতে বিচারস্থলের সকল অংশসহ আদালতের অফিসার, কর্মচারী ও সাক্ষীদের ব্যবহৃত স্থানকেও বোঝায়। অর্থাৎ যখন কোন আইনজীবী আদালতে কোন মামলায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অগ্রসর হন তখন যদি তাকে গ্রেফতার করা হয় তখন আদালতের স্বাভাবিক গতিকে হস্তক্ষেপের শামিল বিধায় তা আদালত অবমাননা হবে। এছাড়া যথার্থ কারণে আইনজীবীকে গ্রেফতার করা আদালত অবমাননা হবে না। তাছাড়া আইনজীবীর চেম্বার আদালতের অংশ বিশেষ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আইনজীবীর বিশেষাধিকারের ব্যতিক্রম:
একজন আইনজীবী প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উল্লেখিত আইননানুগ সুযোগ-সুবিধা বা বিশেষ অধিকার ভোগ করেন সত্য কিন্তু যদি ঐসব সুযোগ-সুবিধা সদ্ব্যবহার না করে তিনি মক্কেলের পক্ষে আদালতে এমন সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন, যার মধ্যে আদালতের মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়ে, তাহলে অবশ্যই তাকে ততখানি অধিকার প্রদান করা চলে না।
Discussion about this post