রোকেয়া লিটা
গতবছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে রাজধানীর বেইলী রোডের একটি ছয়তলা থেকে এক নবজাতককে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। পরে জানা যায়, ওই ছয়তলা বাসার ১৭ বছর বয়সী এক গৃহকর্মী শিশুটির গর্ভধারিণী।
আমি ওই গৃহকর্মীকে গর্ভধারিণী বলে সম্বোধন করলাম, মা বলে সম্বোধন করিনি। কারণ, গর্ভে ধারণ আর মা হওয়া এক জিনিস নয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিশেষ করে ভারত বা চীনে নারীরা স্যারোগেসি পদ্ধতিতে নিজের গর্ভ ভাড়া দিয়ে অন্যের সন্তান প্রসব করছে। তারা কেউই এসব সন্তানের মা নয়।
শুধু গর্ভে ধারণ করলেই মা হওয়া যায় না, মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকতে হয়, সন্তানকে ভালবাসতে হয়।
বেইলী রোডের ওই গৃহকর্মীর না ছিল মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, না ছিল সন্তানের প্রতি ভালবাসা। সে তো তার দুলাভাইয়ের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই একজন ধর্ষকের সন্তানের প্রতি তার কোনো ভালবাসা ছিল না। সেজন্যই তো, নিজের গর্ভে ধারণ করেও সে ছয়তলা থেকে শিশুটিকে ফেলে দিতে পেরেছে।
বেইলী রোডের ঘটনার বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
গত বছরের জুলাই মাসেও, বাড্ডা এলাকার পোস্ট অফিস গলির ভেতর এক ডাস্টবিনে পলিথিনের ব্যাগে মোড়ানো অবস্থায় একটি শিশুকে পাওয়া গেছে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে বহুবার।
ঘটনাগুলো উল্লেখ করলাম, কারণ বাংলাদেশ সরকার “বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-২০১৬” নামে একটি আইন করতে যাচ্ছে, যেখানে ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় বিয়ে হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খসরা আইনের বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গত ৭ই ডিসেম্বর সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমরা ১৮ বছর পর্যন্ত বিয়ের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছি। কিন্তু একটি মেয়ে যদি… যে কোনো কারণে ১২-১৩ বা ১৪-১৫ বছরের সময়ে গর্ভবতী হয়ে যায়- তাকে গর্ভপাত করানো গেল না। তাহলে যে শিশুটি জন্ম নেবে তার অবস্থান কী হবে? তাকে কী সমাজ গ্রহণ করবে?”
প্রধানমন্ত্রী ওই শিশুটির কথা চিন্তা করছিলেন, আমিও শিশুটির কথাই চিন্তা করছি। সরকার উদ্বিগ্ন সমাজ ওই শিশুটিকে গ্রহণ করবে কি করবে না, তা নিয়ে। আমি কিন্তু সমাজকে নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নই।
আমার উদ্বেগ ওই শিশুর মাকে নিয়ে। আমার উদ্বেগ ওই শিশুর বাবাকে নিয়ে।
ধরে নিলাম, আদালত এবং অভিভাবকদের চাপে পড়ে একজন ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করলো। কিন্তু, একজন ধর্ষকের সন্তানকে কি তার গর্ভধারিণী মন থেকে গ্রহণ করতে পারবে? অথবা ওই ধর্ষক, যার প্রবণতাই হলো নারী ধর্ষণ, যে কিনা নিজের শ্যালিকাকেই ধর্ষণ করলো, সে কি আদৌ ওই সন্তানের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত? নাকি প্রধানমন্ত্রী বলতে চাইছেন, কেবল একটি পিতৃ পরিচয় পাওয়াই এই সমস্যার সমাধান?
তাই যদি হবে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে এতো নারী ধর্ষিত হয়েছিল, তাদের অনেকেই তো সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তাদের কি কখনও ধর্ষক পিতার পরিচয় দরকার হয়েছে? হয়নি।
তাহলে, মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পরে এসে কেন ধর্ষক পিতার পরিচয় সন্তানের জীবনে এতো মূল্যবান হয়ে উঠছে?
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিমা বিশ্বে কেউ সন্তানের বাবা-মায়ের পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু বাংলাদেশে স্কুলে ভর্তির জন্য শিশুর বাবা-মা’র নাম উল্লেখ জরুরি। পিতৃ পরিচয় বিহীন শিশুর সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন।
তাহলে কি আমরা ধরে নেবো, বাংলাদেশে যে পিতৃ-মাতৃ পরিচয় বিহীন এতো শিশু রয়েছে এতিমখানায় বা শিশু সদনে, তারা এই সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়? আমি বিশ্বাস করতে চাই, তিনি এমন কিছু বোঝাতে চাননি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় একাধিকার পশ্চিমা বিশ্বের উদাহরণ দিয়েছেন। এতো দূরে গেলেন, অথচ হাতের কাছেই প্রতিবেশীর দিকে তাকালেন না!
ভারত তো অনেক আগেই অবিবাহিত মায়েদেরকে তাদের সন্তানের অভিভাবক হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছে, এক্ষেত্রে বাবার সম্মতির কোনও প্রয়োজন নেই এবং বাবার নাম প্রকাশেরও কোনও প্রয়োজন নেই ।
এমনকি, পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও পিতৃ পরিচয় জরুরি নয় ভারতে (আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন)
রক্ষণশীলতার দিক দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থা একই রকম। ভারত যদি এভাবে অবিবাহিত মায়েদের সন্তানের অভিভাবক হওয়ার স্বীকৃতি দিতে পারে, তবে নারী নেতৃত্বের দেশ বাংলাদেশে কেন নয়? কেন বাংলাদেশে একজন শিশুকে স্কুলে ভর্তি করাতে হলে, তার বাবার নাম দিতেই হবে?
সরকার সামাজিক সমস্যা কমানোর জন্য এমন একটি আইন করতে চাইছে। অথচ এই আইনের ফলে একজন নারীর ব্যক্তিজীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসবে, সে কথাটি কেন ভাবছে না?
এমনিতেই বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ ও শিশু ধর্ষণের হার অনেক বেশী, তার ওপর যদি এমন একটি আইন হয়, তাহলে কোনো কণ্যাশিশু ধর্ষিত হলেই বাবা-মা এই আইনটিকে লুফে নিবে, লোক-লজ্জার ভয়ে তারা তাদের কন্যাশিশুটিকে ধর্ষকের সাথেই বিয়ে দিতে চাইবে।
ফলে, সমাজে ধর্ষণ বাড়বে, কিন্তু ধর্ষকের বিচার চাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। এতে করে আসলে লাভবান হবে ধর্ষকরাই।
একজন ধর্ষক বিবাহ নামক একটি সনদের জোরে প্রতি রাতেই ওই কন্যাশিশুটিকে ধর্ষণ করার বৈধতা অর্জন করবে। একটি শিশুর পিতৃ পরিচয় পাওয়ার আশায়, আরেকটি শিশুকে এভাবে ধর্ষকের হাতে তুলে দেয়ার সত্যিই কোনো মানে হয় কি?
আর তাছাড়া, ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় বিয়ের বিষয়টি আসলেই কতটা যৌক্তিক?
বারবার যে বিষয়টি আসছে, সেটি হলো, “যে কোনো কারণে ১২-১৩ বা ১৪-১৫ বছরের সময়ে গর্ভবতী হয়ে যায় এবং যদি তার গর্ভপাত করানো না যায়”। বিষয়টি কি এমন যে, কেবল ১২-১৩ বা ১৪-১৫ বছর বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটছে বা ঘটবে?
এমন একটি বিপর্যয় তো একজন অবিবাহিত সাবালিকা নারীর জীবনেও ঘটতে পারে যে কোনো সময়। সাবালিকা মেয়েদের তো বিয়ে করতে কোনো সমস্যা নেই, তারা সবাই কি সন্তানের পিতৃ পরিচয় পাওয়ার আশায় ধর্ষককে বিয়ে করতে চাইছে? নাকি ধর্ষকের বিচার চাইছে? নাকি অবিবাহিত মা হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি চাইছে?
সব শেষে বলবো, ষোলো বছরের কম বয়সী একটি মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলেই, যেখানে তা আইনি ভাষায় ধর্ষণ, সেখানে আবার ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়ার চিন্তা তো একেবারেই আইন বিরোধী। প্রেম করেই হোক আর যেভাবেই হোক, উন্নত বিশ্বের দেশ গুলোতেও অপ্রাপ্ত বয়স্কের সাথে গড়ে ওঠা যৌনসম্পর্ককে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, ধর্ষণ বলা হয়।
সরকার ধর্ষককে শাস্তি না দিয়ে, তার সাথে ধর্ষিতার বিয়ের অনুমতি দিয়ে তো ধর্ষককেই পুরস্কৃত করতে চাইছে! সরকার ধর্ষিতার সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত ভালো কথা, শিশু সদনগুলোকে উন্নত করুন। এই সন্তানের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে, কেন এই সন্তানের দায়িত্ব চাপাতে চাইছেন ধর্ষিতার ওপর? সূত্র: বিবিসি বাংলা
লেখক-সাংবাদিক
Discussion about this post