গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, দেশে আসা হেরোইন সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে মায়ানমারে। সেখান থেকে ইয়াবায় রূপান্তরিত হয়ে তা আবার আসছে বাংলাদেশে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মধ্য এশিয়ান দেশ তাজাকিস্তান, কাজাকিস্তান এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে নানা পথ পেরিয়ে, নানা হাত ঘুরে বাংলাদেশে আসছে হেরোইন। বাংলাদেশে আসা হেরোইনের বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে। সেখান থেকে সোজা মায়ানমারে। সে দেশের বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা ৩৭ এমফিটামিন জাতীয় বৈধ-অবৈধ ওষুধ কারখানায় এ হেরোইন ব্যবহৃত হচ্ছে কাঁচামাল হিসেবে। উৎপাদন হচ্ছে নানা ক্যাটাগরির ইয়াবা। সেই ইয়াবা আবার প্রবেশ করছে বাংলাদেশে।
গোয়েন্দারা বলছেন, এক সময় ভারতের মিজোরাম, বাংলাদেশের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল এবং মায়ানমারের আরাকান ও সিয়েটু প্রদেশে প্রচুর পরিমানে পপি গাছের চাষ হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে এসব অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযানে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। ব্যাপক হারে কমেছে পপি কষ বা হেরোইনের কাচাঁমালের উৎপাদন। তাই সংকট দেখা দিয়েছে ইয়াবা তৈরির কাঁচামালের। আর মায়ানমারের ইয়াবা কারখানাগুলোর সেই ঘাটতি মেটাতে ভারত হয়ে বাংলাদেশের গোদাগাড়ী, হিলি ও সাতক্ষীরা হয়ে হেরোইন আসছে বাংলাদেশে। আবার তা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হয়ে মায়ানমারে গিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরিণত হচ্ছে সিডোফিড্রিনে। আর তা থেকে তৈরি হচ্ছে এমফিটামিন বা ইয়াবা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইয়াবা আসার রুট বলতে যেমন কক্সবাজার বা টেকনাফকে চিহ্নিত করা যায়, হেরোইনের ক্ষেত্রে তেমন রাজশাহী এবং গোদাগাড়ী। কেবল হেরোইন আনা-নেওয়া করে এখানকার শতশত পরিবার এখন আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে। দেশে আসা হেরোইনের ৯০ ভাগই আসে গোদাগাড়ী সীমান্ত দিয়ে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে ট্রাকচালক সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, এখানকার প্রশাসনের প্রায় সবাই হেরোইন ব্যবসায় জড়িত। আর এ ব্যবসায় এখানকার অধিবাসীদের ব্যাপক বাহ্যিক পরিবর্তন এসেছে। যার কোনো স্থাবর সম্পত্তি বা বাহ্যিক ব্যবসা-বাণিজ্য নেই এবং কোনো পেশাতেও জড়িত নেই সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামে তারও আছে প্রাসাদসম দালান-বাড়ি।
গত ৬ আগস্ট সারাংপুর ভেরিপাড়ার সৈয়দ আলীর ছেলে রেজাউল করিম ওরফে গাডু ও একই এলাকার মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে তাজিমুলকে ৩ কেজি ২শ’ গ্রাম হেরোইনসহ আটক করা হয়। এ চালানের সঙ্গে আরও ৭ কেজি হেরোইন থাকলেও ছোটছোট দলে গ্রাম্যপথে এ চালান দেশে আসায় বাকি হেরোইন আটকানো যায়নি। এর আগে এ বছরের ২৬ এপ্রিল দুই কেজি ৪শ’ গ্রাম হেরোইনসহ আবদুল লতিফ (৬৫) নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। তবে এ আসা-যাওয়া চলে সারা বছরই।
বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত থেকে আসা হেরোইন গোদাগাড়ী ও রাজশাহী থেকে ট্রাকে করে চলে যায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী এখন এসব ট্রাকের মালিক। সোনা-মসজিদ স্থলবন্দর থেকে এসব ট্রাক চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে হেরোইনের চালান বহন করে। আবার আসার পথে নিয়ে আসে ইয়াবার চালান। চট্টগ্রাম থেকেই ফিরতি ট্রাকে ইয়াবা পৌঁছে দেয় চট্টগ্রামে অবস্থানকারী বর্মাইয়া গডফাদাররা। নজরদারী কম থাকায় রাজশাহী থেকে সেই ইয়াবা আবার নিরাপদেই প্রবেশ করে ঢাকার বাজারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম সিকাদার এ বিষয়ে বলেন, সীমান্তবর্তী গ্রামে একমাত্র রাস্তায় কোনো অভিযান পরিচালনা করতে গেলে আগেই খবর পেয়ে যায় মাদক ব্যবসায়ীরা। এছাড়া প্রশাসনেও মাদক কারবারিদের লোক থাকতে পারে। সেই সঙ্গে আছে সময়মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিযানে পাওয়ার জটিলতা। অনেক সময়ই নিয়মিত কাজের কারণে তারা আমাদের সময় দিতে পারে না। মাদক ব্যবসায়ীরা এখন অস্ত্র বহন করে। খালি হাতে তো তাদের মোকাবেলা করা যাবে না।
বাংলাদেশ থেকে মায়ানমারে হোরোইন যাওয়া এবং ইয়াবা হয়ে ফিরে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরাও বিভিন্ন সোর্স থেকে বিষয়টি শুনেছি। কিন্তু এখনো এমন কোনো প্রমাণ হাতে পাইনি।
রাজশাহী প্রসাশনের পক্ষ থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহার কাছে হেরোইন ধরে দিয়ে কোনো লাভ হয় না। তিনি তা সহজেই আটা বা পাউডারে পরিণত করেন।
তবে পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার ল্যাব নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। এর দুর্বলতা থাকলে চট্টগ্রামে তেলের সঙ্গে কোকেন ধরা পড়ল কিভাবে?
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গোদাগাড়ীর আব্দুল্লাহ, এমদাদুল হক এমদাদ, আলী, শফিকুল ইসলাম বুড়া, খলিল হোসেন, গোদাগাড়ী পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নওশাদ আলী জামাতি ও তার দুই ছেলে আলমগীর এবং জাহাঙ্গীর, গড়ের মাঠের রবি, মাটিকাটার বাবু, আচওয়াভাটার সামাউল, শীষ মোহাম্মদ শিশু, চর আষাঢ়িয়ার মেম্বার জহিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান বুদু, সোহেল, শহীদুল ইসলাম ভোদল, সামিয়ান, মিলন, শরীফুল, সাইফুল হক, টিয়া, দবির হোসেন, আনারুল হক, রিনা বেগম, তারেক, মুরগী আশরাফ, ড্যানি বাবুল, আমিনুল, ইব্রাহীম আলি, মইনুল হক, ১ নং ওয়ার্ড কমিশনার রবিউল, তানোরের জিয়াউর রহমান জিয়া, মজিবুর রহমান হেরোইন ব্যবসার মূল হোতা। এছাড়াও এদের সহযোগিতায় আছে একাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, গোদাগাড়ী উপজেলা ভারতীয় মুর্শিদাবোদ জেলার সীমান্ত ঘেষা উপজেলা। গোদাগাড়ী ও পাশ্ববর্তী সদর উপজেলা চাঁপাই নবাবগঞ্জ পদ্মানদীর ওপারে মাদকের নিরাপদ আশ্রয়। গোদাগাড়ী উপজেলা চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী ও বহনের কাজে নিয়োজিত শিশু, নারী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
ভারতের সীমান্ত ঘেষা মুর্শিদাবাদ জেলার বাংলাদেশ সীমন্ত সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে হেরোইন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। আর এসব কারখান স্থাপন করা হয়েছে একমাত্র বাংলাদেশে হেরোইন ব্যবসার জন্য।
পুলিশের প্রাপ্ত সূত্রে মতে, সেই কারখানাগুলো কাঁচামাল থেকে হেরোইন তৈরির পর তা বাংলাদেশে পাচার করে। ভারতীয় বড় বড় হেরোইন গডফাদাররা মাধ্যমে সীমান্তের এপারের ব্যবসায়ীদের কাছে তা পৌঁছে দেয়।
Discussion about this post