শায়লা জাহান
দেনমোহর বা মোহরানা কে মুসলিম বিয়ের একটি অপরিহার্য শর্ত হিসেবে মানা হয়। স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সেইসাথে স্বামী বিয়ের সময় যে নগদ অর্থ বা স্থায়ী, অস্থায়ী সম্পত্তি স্ত্রীকে প্রদান করেন তাকে দেনমোহর বলা হয়। এটি একজন মুসলিম বিবাহিতা নারীর ধর্মীয় অধিকার। পবিত্র কোরআন শরীফে স্ত্রী কে তার প্রাপ্য দেনমোহর পরিশোধের জন্য জোরালোভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একবার মোহরানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তা রদ করা যায় না। সুতরাং এটি স্বামীর উপর বাধ্যতামূলক পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য বটে। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেনমোহর বিবাহিত নারীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। দেনমোহর যেমন অনাকাঙ্খিত অবস্থায় একমাত্র অবলম্বন তেমনি নিজ পরিবার ছেড়ে নতুন পরিবেশে নিজকে মানিয়ে নেওয়ার যে ক্ষমতা তার পুরষ্কারও বলা যেতে পারে। আবার বিবাহিত সম্পর্কের অবসানের ফলে সৃষ্ট মানসিক চাপ থেকে বের হয়ে নতুনভাবে জীবনকে এগিয়ে নেওয়ারও উপায়মাত্র । প্রাক ইসলামিক যুগে দেনমোহর এর উপর বিবাহিত মেয়েদের কোন অধিকার ছিল না। কিন্তু পবিত্র ইসলাম ধর্মে স্পটভাবে বলা আছে যে, দেনমোহর একজন বিবাহিত নারীর একমাত্র সম্পদ যা তার অভিভাভবক কিংবা কাছের আত্মীয় কেউই দাবি করতে পারবে না।
দেনমোহর এড়ানোর কোন সুযোগ আছে কি?
যদি কোন কারনে মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর নির্ধারণ করা না হয় এবং স্ত্রী ভবিষ্যতে দেনমোহর দাবি করবে না এই শর্তে কোন বিয়ের চুক্তি সম্পাদিত হলেও স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া মাত্রই যথাযথ দেনমোহর পাবার অধিকারী হবে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে, স্ত্রী কিভাবে অনির্ধারিত দেনমোহর আদায় করবে? মুসলিম পারিবারিক আইন (১৯৬১) এর ১০ ধারা অনুযায়ী দেনমোহরের সমগ্র অর্থ চাহিবা মাত্র পরিশোধের উপযুক্ত বলে ধরে নিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী মোহরানার অবশিষ্ট অর্থ স্ত্রী চাহিবামাত্র পেতে পারে। আদালত সেক্ষেত্রে স্ত্রীর পারিবারিক মর্যাদা অনুসারে দেনমোহর নির্ধারণ করবেন। একই আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে স্বামী একাধিক বিয়ে করেছেন পূর্বের স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তাকে অবিলম্বে মোহরানার যাবতীয় টাকা পরিশোধ করতে হবে তা না হলে এটি বকেয়া রাজস্ব ন্যায় আদায়যোগ্য হবে। এই ধারার বিধানুসারে অভিযুক্ত হলে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডের বিধান আছে। সুতরাং দেনমোহর এড়াবার কোন সুযোগ নেই। বিবাহিত স্ত্রী ক্রীতদাসী হলেও তিনি দেনমোহর লাভ করার সম্পূর্ণ অধিকার রাখে। ইসলাম ধর্মানুসারে একজন বিবাহিত মহিলার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, তার নিজস্ব সম্পত্তি পরিচালনা, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একচ্ছত্র অধিকার আছে যা দেনমোহর এর সাথে সম্পর্কহীন। যদিও সাংসারিক কার্যাদি, গৃহপরিচালনা স্বামী স্ত্রী উভয়ের পারস্পারিক সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এর উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া, স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করার মানে এই নই যে, এর বদলে স্বামী তার স্ত্রীর কাছ থেকে নিয়মিত ভাবে আর্থিক সুবিধা নিবে। কিন্তু, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে স্ত্রী তার স্বামীকে যেকোনো অংকের টাকা দিতে পারে যেখানে পারস্পারিক ভালবাসা, বিশ্বাস তাদের মধ্যে বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, স্বামী তার স্ত্রীকে বিভিন্ন সময়ে যেই অংকের অর্থই প্রদান করুক না কেন তা দেনমোহর হিসেবে প্রদান করা হয়েছে বলে গ্রহণযোগ্য হবে না ।
মোহরানার জন্য নির্ধারিত বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক। স্বামীর সম্পত্তি দেনমোহরের বিষয়বস্তু হতে পারে যদি তা স্বামীর একচ্ছত্র অধিকারে থাকে কিন্তু এমন সম্পত্তি যা স্বামীর নামে বা তার অধিকারেই নেই তা দেনমোহর হিসেবে গৃহীত হবে না। এটার বিনিময়ে স্বামী স্ত্রীকে হজ করাবে অথবা স্ত্রীর সেবা করবে এরকম শর্ত অগ্রহণযোগ্য এবং সেইসাথে ভিত্তিহীন ।
দেনমোহর আদায়
দেনমোহর পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত এটিকে স্বামীর উপর বর্তেয় ঋণ বলে গণ্য করা হয়। স্বামী মারা যাবার পর স্ত্রী তার ন্যায্য দেনা আদায়ের জন্য স্বামীর সম্পত্তি দখলে রাখতে পারেন। তাছাড়া, স্বামীর উত্তরাধিকারী যারা আছেন তারাও অবশিষ্ট দেনমোহর প্রদানের জন্য বাধ্য থাকবেন। উল্লেখ্য যে, স্ত্রী দেনমোহরের অবশিষ্ট অর্থ আদায়ের জন্য যেমন তার স্বামীর উত্তরাধিকারীদের সম্মতি নেবার প্রয়োজন নেই ঠিক তেমনি স্ত্রী তার প্রাপ্য অর্থ আদায়ের পর স্বামীর সম্পত্তিতে নিজ অংশ ছাড়াও অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের অংশ দখলে রাখলে তা আইনসম্মত হবে না।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর একজন স্ত্রী তার ধর্মীয় অধিকার দাবী করতে পারে। পবিত্র কোরআন শরীফে উল্লেখিত ‘তালাক’ হচ্ছে একটি অসমর্থিত বিধান যা মহান আল্লাহ্ তাআলা পছন্দ করেন না । কিন্তু, ইহাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে যেক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, অসম্মান, বিষময় অনুভূতি ভয়ংকর ভাবে বেড়ে চলেছে যার জন্য তালাকই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। বিশেষত, এই বিধানটির উদ্দেশ্য হল মুসলিম সমাজের ব্যভিচারকে রোধ করা। বিবাহের পর স্বামী যাতে সহজে স্ত্রীকে তালাক দিতে না পারে কিংবা তালাকের পর একজন মুসলিম নারীকে যেন নিঃস্ব অবস্থায় পরতে না হয় সেই জন্য দেনমোহর স্বামীর উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে । সাধারণত বর্তমান সমাজে দেখা যায় যে, মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর অধিক হারে ধার্য করা হয় যার মূল ভিত্তি হচ্ছে বিবাহিত মেয়েটির সামাজিক, আর্থিক নিরাপত্তা । বিয়েতে অধিক পরিমানে দেনমোহর ধার্য করা হলেও তা স্বামীর আর্থিক ক্ষমতার বাইরে এই ধরনের খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তিনি দেনমোহর প্রদান হতে অব্যাহতি পাবেন না।
মুসলিম বিবাহিত নারী যার স্বামী মারা গিয়েছেন এই অবস্থায় তিনি অধিকার প্রয়োগ করতে চাইলে অবশ্যই তাকে মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে দখল বজায় রাখতে হবে দেনমোহরের বিলম্বিত অর্থ আদায়ের জন্য। সেইসাথে দখলসত্ত্ব বজায় রেখেও স্ত্রী মামলা দায়ের করতে পারবেন। তবে মামলার ডিক্রী অর্থাৎ দেনমোহরের বিলম্বিত অর্থ পাবার পর নিজ সত্ত্ব ছাড়া বাকি সম্পত্তির দখল সত্ত্ব ছেড়ে দিতে হবে। যদি দেখা যায় যে, সম্পত্তি দখলে রেখে মোহরানা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না অথবা মৃত স্বামীর সম্পত্তি দখলাধীন থাকা অবস্থায় স্ত্রীকে দখলচ্যুত করা হয়েছে সেক্ষেত্রে তিনি স্থাবর সম্পত্তি হলে ছয় মাসের মধ্যে এবং অস্থাবর সম্পত্তি হলে তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে পারবেন।
দেনমোহর, ভরণপোষণ এবং উত্তরাধিকার একে অপরের সাথে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র মৌলিক আইন। সাধারণত দেনমোহরের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় বিবাহ বিচ্ছেদের সময়। অর্থাৎ স্বামী যখন তার স্ত্রীকে তালাকের নোটিস প্রেরন করবে তার তিন মাস অতিবাহিত হয়ে যাবার পর তালাক কার্যকর হবে এবং অবিলম্বে তিনি মোহরানার সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করবেন। তালাক হয়ে যাবার মাধ্যমে স্ত্রীর স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সত্ত্ব লোপ পাবে । কিন্তু স্বামী মারা গেলে যে বৈবাহিক সম্পর্কের অবসান ঘটে সেই ধরনের বিচ্ছেদে স্ত্রীর উত্তরাধিকার অটুট থাকে। এমন যদি হয় যে, স্বামী মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন তাহলে ইদ্দত কাল শেষ হবার পর স্ত্রীর উত্তরাধিকার সত্ত্ব লোপ পাবে এবং তিনি মোহরানার সম্পূর্ণ টাকা দাবি করতে পারবেন
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
Discussion about this post