‘আমার মেয়ের বয়স ছিল আট মাস। সবার কোলে কোলে থাকার বয়স, কোলেই থাকত। কিন্তু ওই মেয়েকে রেপ করছে। বাবা হয়ে আমি আর কী বলব? আমি কোনো কিছু কইরাই শান্তি পাই না। আমি এর বিচার চাই।’
গত সপ্তাহে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি আয়োজিত নারী নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে এক বাবা এভাবেই তাঁর অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। এই বাবা গাজীপুরে থাকেন। গত বছরের আগস্ট মাসে তাঁর মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দেন। ধর্ষণের ঘটনার পর জয়দেবপুর থানায় মামলা করেছেন বাবা। মামলা করার পর স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। তবে আসামিপক্ষের হুমকি তাঁর পিছু ছাড়েনি।
ব্র্যাকের অনুষ্ঠান শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে ওই বাবার কথা হয়। বাবা যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর সারা শরীর কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে বের করলেন মামলার আসামির একটি রঙিন ছবি। জানালেন, আসামি আর তাঁরা পাশাপাশি ঘরে থাকতেন। সকালে মেয়েকে কোলে নিয়ে বেড়াতে যান শিশুটির ফুফু। আসামির স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তিনি মেয়েকে কোলে নেন। শিশুটির ফুফু তাকে আসামির ঘরে রেখে চলে আসেন। আসামির স্ত্রী শিশুটিকে বিছানায় রেখে রান্না ঘরে যান। আসামি তখন ঘরেই ছিলেন। কিছুক্ষণ পর শিশুটির চিৎকারে সবাই দৌড়ে যান। তখন আসামি শিশুটির কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন।
বাবা বলেন, ‘তখন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি ঘটনা কী ঘটেছে। মেয়ের প্রস্রাবের রাস্তা দিয়া রক্ত পড়তে থাকে। গাজীপুরে এক হাসপাতালে নিলে ওই জায়গায় তিনটি সেলাই দিতে হয়। এলাকার লোকজনকে ঘটনার কথা জানানো হইছে।’
শিশুটি এখন একটু বড় হয়েছে। বাবা বললেন, ‘ঘটনার পর থেকে আসামি পলাতক। তবে তাঁর লোকজন কেস তুলে নিতে বলে। ৫০ হাজার টাকা দিতে চায়। কিন্তু আমি চাই আসামিরে পুলিশ ধরুক। ঘটনার বিচার চাই।’
গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ মোবাইলে গণমাধ্যমকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (সংশোধিত ২০০৩) মামলা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ হয়েছে। আসামিকে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে বিচারের জন্য আদালতে প্রক্রিয়াধীন।
মামলার আসামি এখন পর্যন্ত পলাতক এবং তাঁর লোকজন শিশুটির বাবাকে হুমকি দিচ্ছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাসেল শেখ বলেন, গাজীপুরে বেশির ভাগ লোকজন কাজের জন্য আসে। অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে বসবাস করে। বাড়িওয়ালারাও সেভাবে ভাড়াটের তথ্য সংগ্রহ করেন না। একটি ঘটনা ঘটলে তখন আর ওই ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় তিন বছরের নিচে কমপক্ষে ২৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। গত বছর পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত অপরাধ সম্মেলনে শিশু ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি দেশের ৫৫টি জেলার ১২ হাজারের বেশি কমিউনিটিভিত্তিক নারী সংগঠন ‘পল্লী সমাজ’ এবং ব্র্যাকের অন্যান্য কর্মসূচি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত বছর একটি ডেটাবেইস বা তথ্যভান্ডার তৈরি করে। এ তথ্যভান্ডার বলছে, ০ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুরা ধর্ষণ, গণধর্ষণের শিকার হয়। এই বয়সীদের বেলায় ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনাও বেশি ঘটে। এই বয়সী মেয়েশিশুদের মোট ১২৯টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়, যার মধ্যে ৫৭টি ধর্ষণ, একটি গণধর্ষণ এবং ৩৭টি ধর্ষণ চেষ্টা অর্থাৎ মোট ৯৫টি ঘটনাই ঘটেছে ধর্ষণ সম্পর্কিত। ধর্ষণের ঘটনায় প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুর সংখ্যা ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি ছিল। তথ্যভান্ডারের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী প্রতিদিন প্রায় দুজন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ৪৭ শতাংশই ঘটে প্রতিবেশীদের মাধ্যমে।
-প্রথম আলো
Discussion about this post