কুমার দেবুল দে
সম্প্রতি দেশব্যাপী আলোচনার বিষয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অসুস্থতাজনিত দেশত্যাগ, আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিদের তাঁর সাথে বিচারিক কার্যক্রমে অংশগ্রহনে অনাগ্রহসহ প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি, চারিত্রিক স্খলনসহ ১১ অভিযোগ। এসব অভিযোগ নিয়ে তিনি (এস কে সিনহা) আপাতত অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। যদিও দেশত্যাগের সময় তিনি বলে গিয়েছেন যে তিনি বিব্রত, তিনি পালিয়ে যাচ্ছেন না। তিনি আবার ফিরে আসবেন, তার এই যাত্রা সাময়িক। তিনি বিচার বিভাগের স্বার্থেই আপাতত দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তার বক্তব্য থেকে আমরা মনে করতে পারি তিনি খুব শীঘ্রই দেশে ফিরছেন। তবে দেশে ফিরে বিচারিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি-না তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহের অবকাশ আছে।
প্রথমত, এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতির স্বপদে ফিরে আসা সুদূরপরাহত। এটর্নি জেনারেলের বক্তব্য সরকারের বক্তব্য হওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ তিনি দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা, তিনি যা বলেন বা করেন তা অবশ্যই সরকার দ্বারা নির্দেশিত। এখন যদি এটর্নি জেনারেল সাহেবের বক্তব্যের উপর আস্থাশীল হই তবে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সাহেবের স্বপদে বহাল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নাই।
দ্বিতীয়ত, দেশত্যাগের দিনে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের জবাবে দেয়া সুপ্রীম কোর্টের বিবৃতি পর্যালোচনা করলে তাঁর বিরুদ্ধে (এস কে সিনহা) আনীত ১১ অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিবৃন্দ তার সাথে একই বেঞ্চে বসবেন না। অন্যদিকে যেহেতু এই ১১ অভিযোগের আশু সুরাহার কোন সম্ভাবনা নাই তিনি আর বেঞ্চে বসতে পারছেন না কারণ আইনে প্রধান বিচারপতির একক বেঞ্চে বসার কোনো সুযোগ নাই। ফলে প্রধান বিচারপতি হিসাবে তাঁর (সিনহা) দায়িত্বে ফিরে আসা ও বিচার কাজে অংশগ্রহণ বাস্তবতার নিরিখে কোনভাবেই সম্ভব নয়।
অসুস্থতাজনিত, বিদেশ ভ্রমনজনিত বা অন্যকোনো কারণে প্রধান বিচারপতির পদটি সাময়িক ফাঁকা হলে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর্মে প্রবীনতম আপীল বিভাগের বিচারপতিকে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন। ফলে তিনি প্রধান বিচারপতির যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করার আইনগত ক্ষমতা লাভ করেন। এক্ষেত্রে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি কি কি কাজ করতে পারবেন তা নিয়ে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার কি কি হতে পারে কিংবা প্রধান বিচারপতির সমস্ত কার্যাবলী তিনি সম্পাদন করতে পারেন কিনা? এ নিয়ে সর্বসাধারনের মনে এতদিন পর্যন্ত কোন প্রশ্ন উত্থাপিত না হলেও বর্তমানে হচ্ছে। কারণ-
প্রথমত, এর আগে প্রধান বিচারপতির পদ খালী হতো মাত্র ২/১ দিনের জন্য কিংবা সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের জন্য। ফলে যিনি অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকতেন তিনি শুধুমাত্র রুটিন মাফিক কিছু কাজ করে যেতেন তাঁর তেমন বড় কোন পরিবর্তন করতে হতো না।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত কারণে নিয়মিত প্রধান বিচারপতির দীর্ঘ ১ মাস ১০ দিনের অবকাশকালীন সময়ে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে হচ্ছে, যেমন নিম্ন আদালতের বিচারকদের ছুটি, পদোন্নতী, পদায়ন নিয়োগ ও কর্মস্থল পরিবর্তনসহ আরো অনেক বিষয়ে সিদ্বান্ত নিতে হচ্ছে। পাশাপাশি নিয়মিত প্রধান বিচারপতির কাজে যোগদানের সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়ায় এ নিয়ে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলে এসব কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতেই অস্থায়ী প্রধান বিচারপতিকে একটা ভূমিকা রাখতে হচ্ছে।
শব্দটিকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদনকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি বলে অভিহিত না করার সাংবিধানিক কারণ আছে। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদের শিরোনামেই বলা আছে শব্দটি হবে “অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি” কাজেই তিনি রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি সাপেক্ষেই নিয়োগ পান। এক্ষেত্রে নিয়োগের গেজেট জারি হয় ফলে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা খর্ব করার কোন সুযোগ সংবিধানে নেই। মাননীয় প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব ও কাজ হবে সংবিধান মোতাবেক, এই কাজের প্রকৃতি তিন ধরনের- ১. বিচারিক, ২. প্রশাসনিক ও ৩. আনুষ্ঠানিক।
সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বিচারিক কাজের ক্ষেত্রে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়মিত প্রধান বিচারপতির সমস্ত কার্যাবলী হুবহু পরিচালনা করতে পারেন। ঠিক একই রকমভাবে প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রেও অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা নিয়মিত প্রধান বিচারপতির সমান। তবে একটা বিষয়ে প্রশ্ন আছে তা হল একজন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির আনুষ্ঠানিক কাজের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির হুবহু বা একই রকম ক্ষমতা আছে কি-না?
বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগে বিচারক স্বল্পতা রয়েছে এবং যদি সরকার উভয় বিভাগে নতুন বিচারপতি (হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগে) নিয়োগ দেয় সেই ক্ষেত্রে নিয়মিত প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির ভূমিকা কি হবে? নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বিচারিক কার্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ নেয়া আবশ্যক নতুবা তিনি বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। অতীত উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সরকার কর্তৃক নিয়োগ পাওয়ার পরেও ২ জন বিচারপতিকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব ফজলুল করিম শপথ পড়াতে অনাগ্রহ প্রকাশ করাতে আদালতে বসতে পারেন নি। পরবর্তীতে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর উক্ত ২ জন বিচারপতির শপথ পাঠ করানোর পর নিয়োগ সম্পন্ন হয় এবং বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের বাধা দূর হয়।
সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, যে সকল সাংবিধানিক পদে দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই শপথ গ্রহণ করিতে হইবে এবং শপথ না নেয়া পর্যন্ত কেউ উক্ত পদাধিকারী হয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারবেন না। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে শপথ বাক্য গুলো কি হবে, কি শব্দে শপথ বাক্য পড়তে হবে তার নমুনা এবং কে শপথ পাঠ করাবেন সেসবের বিস্তারিত রয়েছে সংবিধানের তৃতীয় তফসীলে “শপথ ও ঘোষনা” শিরোনামের ৬ নং কলামে। এখানে বলা আছে, প্রধান বিচারপতিকে শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিদের শপথ পড়াবেন প্রধান বিচারপতি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যেহেতু অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথের মধ্যে থাকেন না বা শপথ নেয় না, ফলে তিনি এই শপথ পরিচালনা করতে পারেন কিনা? তাছাড়া আমাদের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে “প্রধান বিচারপতি” এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে “প্রধান বিচারপতি অর্থ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি”। সুতরাং যেহেতু সংবিধানে প্রধান বিচারপতি বলতে শুধুই প্রধান বিচারপতিকে বুঝানো হয়েছে সেইক্ষেত্রে এই প্রধান বিচারপতি কোন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি বা প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার সম্পাদনকারী কোনো বিচারপতি নয়। প্রধান বিচারপতি মানে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ পাওয়া ও শপথ নেয়া বিচারপতিকেই বুঝাবে এর কোন বিকল্প নয়।
তবে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলে সংবিধানের ১৪৮ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বর্তমান অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি অথবা যে কেউ নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের শপথ পড়াতে পারবেন এবং তা একেবারেই সংবিধান সন্মত। সংবিধানের ১৪৮ (২) অনুচ্ছেদের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলঃ “এই সংবিধানের অধীন নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির নিকট শপথগ্রহণ আবশ্যক হইলে (এবং কোন কারণে সেই ব্যক্তির নিকট শপথ গ্রহণ সম্ভব না হইলে) অনুরুপ ব্যক্তি যেরুপ ব্যক্তি ও স্থান নির্ধারণ করিবেন, সেইরুপ ব্যক্তির নিকট সেইরুপ স্থানে শপথ গ্রহণ করা যাইতে পারে”।
সুতরাং অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিজে কিংবা অন্য কোন বিচারপতিকে এই শপথ পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করে থাকে তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত উক্ত বিচারপতি একেবারেই সংবিধানসন্মত ভাবেই নবনিযুক্ত বিচারপতিদের শপথ পরিচালনা করতে পারবেন। তাছাড়া অনুচ্ছেদ ১৪৮ এর বক্তব্য থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে যিনি নিয়োগ পাবেন তার শপথ পড়াটা বাধ্যতামূলক বা তাকে অবশ্যই শপথ পড়তে হবে, কে শপথ পড়াবেন বা কার কাছ থেকে শপথ পড়বেন জরুরী প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
লেখক: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী সদস্য।
Discussion about this post