অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
প্রেম অতঃপর ধর্ষণ কিংবা হত্যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি মামুলি ব্যাপার। প্রতিনিয়ত ঘটছে, মামলা হচ্ছে, আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দোষীরা বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না এ নির্দয় ঘটনাবলী।
এইতো সেদিন আদালতে বসে আছি একটি চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানি শুনতে। সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য্য আছে। সিনিয়রের উপদেশ মতো জবানবন্দি ও জেরার কুশলাদি রপ্ত করার জন্যই মূলত অপেক্ষা। পেছনে তাকিয়ে দেখি ভাঙা চেহারা, রোগামতো একটি দরিদ্র শ্রেনীর লোক। আইনজীবীদের জন্য নির্ধারিত আসনের পেছনের আসনে বসে আছে। গায়ের শার্টটিও ছেঁড়া, লুঙ্গি পরা। ডাগর ডাগর দুটি চোখ জুড়ে যেন সরলতার প্রতিচ্ছবি। ওই দুটি চোখই বলে দেয়, তার হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউ। আমি কৌতুহলবশতঃ তাঁর সাথে কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে উঠি।
আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। ফিস ফিস করে তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে পারি?’ লোকটি হকচকিত হয়ে বললেন, ‘কী কথা ভাই?’ বললাম, ‘চলুন, বাইরে বারান্দায় যাই। এখানে তো কথা বলা যাবে না। আমরা দুজন পেছন থেকে বেরিয়ে এলাম দোতলার বারান্দায়।’ লোকজনের ভিড় ঠেলে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। প্রথমে কোন কিছু বলতে ইতস্তত বোধ করলেও আমি সাংবাদিক কাম আইনজীবী একথা শুনে আবেগি গলায় বলতে শুরু করলেন।
দরিদ্র পরিবারে ষোড়শী সখিনা (ছদ্মনাম) ভালবেসেছিল অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে মাসুমকে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। গর্ভবতী হয়ে পড়ায় মেয়েটি বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাকে ঘুরাতে থাকে। ৩ মার্চ, ২০১৫ রাতে ওই ছেলে সহ কয়েক বন্ধু মেয়েটির বাড়িতে আসে বিয়ে বিষয়ে কথা বলার জন্য। ছেলেটি যৌতুক হিসেবে এক লক্ষ টাকা চায়। দরিদ্র পিতা এত টাকা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। ওরা বকাবকি করতে করতে চলে যায়। রাত দুইটার দিকে মোবাইল ফোনে মেয়েটিকে বিয়ের কথা বলে গোপনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে মেয়েটিকে না পেয়ে বাড়ির লোকজন খোঁজ করতে থাকে। অবশেষে বাঁশ বাগানের মধ্যে মেয়েটির লাশ পাওয়া যায়। গল্পের সেই লোকটি বোন হত্যার বিচার চেয়ে থানায় মামলা করেন। মামলা দিয়েছে হত্যা মামলার। দ-বিধির ৩৪/২০১/৩০২ ধারায়। পুলিশ আসামীপক্ষে টাকা খেয়ে আসামি দিয়েছে অজ্ঞাতনামা।’
বললেন, ‘ভাই, থানা-পুলিশের ওপরে আমার আর কোনো আস্থা নেই। সবখানেই টাকার খেলা। আমি তো গরিব। গরিবের ছেলে। এত টাকা-পয়সা দিয়ে কিছু ম্যানেজ করতে পারি না। থানা-পুলিশকে পোষাইতে পারি না। আমার বোনের হত্যার বিচার হবে কি না, জানা নেই। আসামিরা অনেক প্রভাবশালী, টাকা-পয়সার জোর বেশি। ওরা টাকার জোরে খালাস পেয়ে যাবে।’
নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম, যদি আমার বোন এরকম ধর্ষিত হতো, ধর্ষণের পর হত্যা করা হতো, রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজ, আইন সবাই জানার পরও যদি কোন ব্যবস্থা না নিতেন, তাহলে আমি কি করতাম?
বিবেকের তাড়না থেকে অবশেষে অমি নিজ থেকে মামলাটির খোঁজ খবর নিই। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সংগ্রহ করি। ডাক্তারের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে গর্ভবতী ছিল, বলা হয়েছে। আসামীরা থানা পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদীকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকিও দিচ্ছে। বাদীর ভাষায় ‘আমরা পুলিশের কাছে বলেছি, সবার নামও দিয়েছি। কিন্তু পুলিশ বলে, আমরা নাকি মিথ্যা করে নাম দিয়েছি। নামগুলো থাক, তদন্ত করে দেখি আগে। পরে শুনেছি থানায় ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আসামিদের নাম যাতে না দেয়, এ ব্যবস্থা করেছে। আমি তো লেখাপড়া জানি না। আমি এখনো জানি না, পুলিশ মামলায় কী লিখেছে।’ দীর্ঘ কথোপকথনে আমি ওই লোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে আসি। আর আদালতের ভেতর প্রবেশের মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলি।
পরে আমি নিজ উদ্যোগে লোকটির খোঁজ করি। আদালতে বাদীর মাধ্যমে হলফনামা দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম দাখিল করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে থানাকে পুনরায় তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের বাধ্যতামূলক নির্দেশে মামলাটির চার্জশিট দেওয়া হয় নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইনের ৯(৩) ধারায়। এ ধারায় বলা হয়েছে যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে যদি কারও মৃত্যু হয় বা আহত হয় তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। ওই চার্জশীটে চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে এক নম্বর আসামি গ্রেফতার হয়। বাদীর মুখে হাসির চমক দেখা দেয়। আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে চায়। বিচার দেখে মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে বোন হত্যার বিচারপ্রার্থী সেই লোকটিকে বিদায় করি।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘সময়ের দিগন্ত’।
Discussion about this post