বিডি ল নিউজঃ ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশিত হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় আপিল বিভাগের ওয়েবসাইটে রায়ের এ পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ করা হয়েছে।মোট ১৩৮ পৃষ্ঠার এই রায়ে ফতোয়া কারা দিতে পারবে, ফতোয়ার প্রেক্ষাপট ও পর্যবেক্ষণসহ বিচারপতিদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে মূল চারটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১১ সালের ১২ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন— বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন (সাবেক প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি এসকে সিনহা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী।
প্রায় পৌনে চার বছর অপেক্ষার পর রবিবার ‘ফতোয়া’ নিয়ে আপিল বিভাগ ঘোষিত চূড়ান্ত ওই রায় লেখা শেষে বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়।
রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, শুধুমাত্র যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিগণই ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দিতে পারবে। যা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে কোনো বল প্রয়োগ বা অন্যান্য প্রভাব ব্যবহার করা যাবে না।
রায়ে আরও বলা হয়, দেশের প্রচলিত আইনে বিধান আছে, এমন বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে কারো অধিকার, খ্যাতি বা সম্মানহানি করা যাবে না। এর মাধ্যমে কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক শাস্তিও দেওয়া যাবে না।
একই সঙ্গে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মূল রায় লেখেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তবে তার সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে পৃথক রায় দেন বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা। এই বেঞ্চের অন্য চার বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তবে একমত পোষণের পরও ১৩৮ পৃষ্ঠার এই রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ৩৯ পৃষ্ঠার সংযুক্তি লিখেছেন।
ফতোয়া কিঃ ফতোয়া বিষয়টি হচ্ছে মান্য করার একটি বিষয়। ফতোয়া হচ্ছে একটি মতামত, ব্যাখ্যা এবং সিদ্ধান্ত। বাংলা পিডিয়াতে ফতোয়ার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে— ফতোয়া বা ফাতওয়া হচ্ছে ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ অথবা মুফতি কর্তৃক প্রদত্ত বা প্রকাশিত বিধান।
প্রসঙ্গত, ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ফতোয়া সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামের এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করা হয়। বিষয়টি নজরে এলে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। রুলের চূড়ান্ত শুনানী শেষে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ বলে রায় দেন।
ওই রায়ে বলা হয়, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইন সংক্রান্ত কোনো মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে মুফতি মো. তৈয়ব এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আপিল করেন। এরপর আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও নারী নেত্রী মালেকা বেগমসহ অন্যরা মামলায় পক্ষভুক্ত হন। ১০ বছর পর, অর্থাৎ ২০১১ সালের ১ মার্চ আপিলের শুনানী শুরু হয়। শুনানীতে আদালত-বন্ধু (এ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে প্রবীণ আইনজীবী টিএইচ খান, রফিক উল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, ড. এম জহির, এবিএম নুরুল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ এবং এমআই ফারুকীর বক্তব্য গ্রহণ করে আপিল বিভাগ।
এ ছাড়া পাঁচজন আলেমের বক্তব্যও শোনে আদালত। এরপর ওই বছরের ১২ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে পর্যবেক্ষণসহ সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন।
Discussion about this post