আইন বিরুদ্ধ সব কাজই কি অনৈতিক?
আইন ও নৈতিকতা বিষয়দুটি একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমনিভাবে আইনের মূল ভিত্তি হল নৈতিকতা। তেমনি নৈতিকতা বা নৈতিক বিধিসমূহ বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে আসে আইনের মাধ্যমে। জীবনের একটি বিষয়ের সাথে যেমন অন্যান্য অনেক বিষয় জড়িয়ে যায়, আইনের ক্ষেত্রেও তেমনি নৈতিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি জড়িয়ে পড়ে, কারণ এখানে যে নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে ঔচিত্যের বিষয়টি নিহিত থাকে। রাজনৈতিক আইন ছাড়া সমাজব্যবস্থায় আরো কতগুলো বিষয় থাকে, যার দ্বারা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলোকেই নৈতিক বিধি বলা হয়৷ প্রাচীনকালে আইন এবং নৈতিকতার মধ্যে কোন তফাৎ ছিল না। প্লেটো-এরিস্টটল যুগে আইনসমূহ নীতিশাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল। মূলত আইন এবং নৈতিকতা দুটোর উদ্দেশ্যই হল সুষ্ঠু, সুসংবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ জীবন সম্ভব করা৷
দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি:– দার্শনিকগণ আইন ও নৈতিকতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গেছেন। ১. প্রকৃতিবাদী দার্শনিক। ২. আইনগত প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিক। –
প্রকৃতিবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, ঝোঁকের বিপরীত হল আইন। এ সম্পর্কে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলেন, বস্তুত আইনের নিয়ন্ত্রণ যদি না থাকে তাহলে আমরা ঝোঁকবশত যা করতে চাই তা করতে পারি। আইনকে ঝোঁকের বিপরীত বলা হয় এই কারণে যে, ঝোঁক নিয়ন্ত্রণমুক্ত কিন্তু আইন নিয়ন্ত্রিত। কান্ট আরো বলেন, আইনের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় দেখা যায়,
১. নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও ২. অধিকার(যখন আইন প্রণয়ন করা হয় তখন আইন প্রণয়নকারী আইন শাসনকারীকে কিছু অধিকারও প্রদান করে)। আর যখনই আইনের সাথে অধিকারের বিষয়টি জড়িয়ে পড়ে তখন এর সাথে নৈতিক বাধ্যবাধকতাও জড়িয়ে পড়ে। আর তাই প্রকৃতিবাদীরা বলেন, আইনকে যতই আমরা একটা নীতি হিসেবে দেখিনা কেন, এর সাথে নৈতিক বাধ্যবাধকতাও অবশ্যই জড়িত। কেননা আইনের সাথে ন্যায়পরায়ণতা, ঔচিত্য ও সর্বসাধারণের মঙ্গল প্রভৃতি বিষয়গুলো জড়িত থাকে।
অপরদিকে আইনগত প্রত্যক্ষবাদীরা, আইনকে নৈতিকতা থেকে আলাদা করে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, আইন আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করে কিন্তু নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না। তাই তারা বলেন, উচিৎ-অনুচিত ইত্যাদি নৈতিক বাধ্যবাধকতা না এনে বরং নিষেধ, নির্দেশ ইত্যাদি আইনগত বাধ্যবাধকতা দ্বারা আমরা আইনকে ব্যাখ্যা করতে পারি। যেমন ধরা যাক, আমার কাছ থেকে কেউ ৫০০ টাকা ঋণ নিয়েছে, সুতরাং আইন অনুযায়ী আমি টাকা ফেরৎ চাইলে সে তা দিতে বাধ্য। এক্ষেত্রে সে যদি টাকা ফেরৎ না দেয় এবং আমি এর জন্য মামলা করি- তখন এর সাথে আইনগত বাধ্যবাধকতা জড়িত থাকে, নৈতিক বাধ্যবাধকতা নয়৷
আইনের সাথে নৈতিকতার বৈসাদৃশ্য:
আইন যেমনিভাবে নৈতিকতার উপর নির্ভরশীল, তেমনি এদের মাঝে অল্প কিছু পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। যেমনঃ- ১. রাষ্ট্রীয় আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু নৈতিকতা মানুষের অন্তজীবনের সাথে সম্পর্কিত। ২. আইন সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট, কিন্তু নৈতিকতা অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট৷ যেমন- ভিক্ষুককে দান করা অনেকের নিকট নীতি বিরুদ্ধ, আবার অনেকের নিকট সেটা নৈতিক দায়িত্ব। ৩. আইন ও নৈতিকতার ক্ষেত্র সবসময় একরকম হয় না৷ কোনো কিছু আইন বিরুদ্ধ হলেও অনৈতিক নাও হতে পারে।
আইন বিরুদ্ধ সব কাজই কি অনৈতিক?
সব আইন মাত্রই যদি নৈতিক হত, তাহলে মানুষ আইনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বাতিলের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলত না৷ এবং আইন প্রণেতাদের আইন সংশোধনেরও প্রয়োজন হত না। যদিও আইন নৈতিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তারপরও প্রেক্ষাপটের দরুন আইন বিরুদ্ধ কাজই নৈতিকতা বিরুদ্ধ হয়ে যায় না। এ সম্পর্কে কিছু উদাহরণ দেখা যাক। -এক্ষেত্রে ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণকে আমরা উল্লেখ করতে পারি৷ যেটা আইন বিরুদ্ধ আচরণ হতে পারে, তবে সর্বদা অনৈতিক আচরণ বললে ভুল হবে। একজন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে, নানা কারণে তার সেই চেস্টা বিফল হতে পারে। সরকারি দীর্ঘসূত্রিতা, অংশীদারদের অসহযোগিতা, বাজারে মন্দা, বিদেশি মুদ্রার ওঠাপড়া, এমন অনেক কারণ সম্ভব। অতএব যারা ঋণ ফেরতের শর্ত মানতে পারেনি তাদের বিবেকহীন বলাটা ভুল হবে৷ -আবার, একটা মানুষ কয়েকদিন ধরে অভুক্ত থাকার পর ক্ষুধা নিবারণের চেস্টায় কিছু খাদ্য যদি চুরি করে খায়, সেক্ষেত্রে সেটা আইন বিরুদ্ধ হবে। তবে, অনৈতিক বলা যাবে না।
সারসংক্ষেপ– আইন ও নৈতিকতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও পরস্পর নির্ভরশীল দুটি বিষয়৷ আইন ও নৈতিকতার বিষয়বস্তু এবং উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন৷ মানুষের কল্যাণই উভয়ের লক্ষ্য। আর এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হল আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যেটা ভঙ্গ করলে দৈহিক ও মানসিক শাস্তি পেতে হয়৷ আর নৈতিকতা ভঙ্গকারী শুধু মানসিক কষ্ট ভোগ করে।
Discussion about this post