চলমান বছরগুলোতে দেশে হরতাল, অবরোধ ও আন্দোলনের নামে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। এমন সব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার অনেক আগেই একটি আইন প্রণয়ন করে যা আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুতবিচার) আইন, ২০০২ নামে পরিচিত।অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কিছু অপরাধের দ্রুত বিচারের উদ্দেশ্যে সরকার এই আইন প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের কতটুকুই বা বাস্তবায়ন হচ্ছে এমন প্রশ্ন এখন প্রায় সবার কাছে। কারণ এই আইন প্রণয়নের পরও কমছে না দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য কিংবা ভাঙচুরের মত দৈনন্দিন ঘটনা। আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ ও এর শাস্তি নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল যেখান থেকে এই আইন ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
কোন কোন কর্মকাণ্ড আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ
১. কোনো প্রকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বা বেআইনী বল প্রয়োগ করে কোনো ব্যক্তি, বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে চাঁদা, সাহায্য বা অন্য কোনো নামে অর্থ বা মালামাল দাবী, আদায় বা অর্জন করা বা অন্য কোনো প্রকার সুযোগ-সুবিধা আদায় করা বা আদায়ের চেষ্টা করা; বা
২. কোনো প্রকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বা বেআইনী বল প্রয়োগ করে স্থলপথ, রেলপথ, জলপথ বা আকাশপথে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা বা বিঘ্ন সৃষ্টি করা বা কোনো যান চালকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যানের গতি ভিন্ন পথে পরিবর্তন করা; অথবা
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো যানবাহনের ক্ষতিসাধন করা; অথবা
৪. ইচ্ছাকৃতভাবে সরকার, বা কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বা কোনো প্রতিষ্ঠান, বা কোনো ব্যক্তির স্থাবর বা অস্থাবর যে কোনো প্রকার সম্পত্তি বিনষ্ট বা ভাংচুর করা; অথবা
৫. কোনো ব্যক্তির নিকট হতে কোনো অর্থ, অলংকার, মূল্যবান জিনিসপত্র বা অন্য কোনো বস্তু বা যানবাহন ছিনতাই এর চেষ্টা করা বা ছিনতাই করা বা জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়া; অথবা
৬. কোনো স্থানে, বাড়ী-ঘরে, দোকান-পাটে, হাটে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে বা প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পিতভাবে বা আকস্মিকভাবে একক বা দলবদ্ধভাবে শক্তির মহড়া বা দাপট প্রদর্শন করে ভয়ভীতি বা ত্রাস সৃষ্টি করা বা বিশৃঙ্খলা বা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা; অথবা
৭. কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দরপত্র ক্রয়, বিক্রয়, গ্রহণ বা দাখিলে জোরপূর্বক বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা বা কাউকে দরপত্র গ্রহণ করতে বা না করতে বাধ্য করা; অথবা
৮. কোনো সরকারী বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বা তার কোনো নিকট আত্মীয়কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ঐ কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে কোনো কাজ করতে বা না করতে বাধ্য করা কিংবা তার দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকারের বাধা সৃষ্টি করা।
আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের শাস্তি
১. এই আইনে কোনো ব্যক্তি কোনো আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ করলে তিনি অন্যুন দুই বৎসর এবং অনধিক পাঁচ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
২. এই সব অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনকালে সরকার কিংবা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতিসাধন করলে তার জন্য আদালত সে বিবেচনায় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, ক্ষতিগ্রস্ত সরকার বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অনুকূলে প্রদান করবার জন্য উক্ত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আদেশ দিতে পারবে এবং এই ক্ষতিপূরণের অর্থ সরকারী দাবী হিসাবে আদায়যোগ্য হবে।
৩. কোনো ব্যক্তি কোনো আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করলে তিনি উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
এই আইনে মিথ্যা মামলা
যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ সংঘটনের কোনো ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তা হলে প্রথম ব্যক্তি কম পক্ষে দুই বৎসর এবং অনধিক পাঁচ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
জামিন সংক্রান্ত বিধান
রাষ্ট্রকে শুনানীর যুক্তিসংগত সুযোগ দিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে আদালত কিংবা আপীল আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত কিংবা ক্ষেত্রমত দণ্ডপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া ন্যায়সংগত হবে তা হলে সেই মর্মে কারণ লিপিবদ্ধ করে আদালত কিংবা ক্ষেত্রমত আপীল আদালত ঐ ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিতে পারবে।
যদিও এই আইনের নাম “আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুতবিচার) আইন” কিন্তু বাস্তবে দ্রুত তো দূরের কথা বছরের পর বছর এই আইনে আটক অপরাধীদের বিচার কাজ সঠিক সময়ে সম্পন্ন হচ্ছে না কিংবা ধীর গতিতে চলছে। আসামীরা জামিন পেয়ে বের হয়ে আবার এমন সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আর পুলিশের যৌক্তিক অযৌক্তিক সন্দেহের শিকার হয়ে অনেকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলখানার অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে।
লেখকঃ মোঃ জাহিদ হোসেন, সভাপতি, হিউম্যান রাইটস স্টুডেন্ট কাউন্সিল, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, চট্রগ্রাম শাখা
Discussion about this post