শামস উদ্দিনঃ
আপনি আপনার মা-বাবা ও নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রেই জমির অংশ পাবেন। হয়তো ওই সম্পত্তি ভোগ করছেন। যখনই জমিটা বিক্রি করতে যাবেন বা কারো কাছে হস্তান্তর করবেন, তখন কিছু শব্দের মুখোমুখি হতে হবে। খতিয়ান ও নামজারি শব্দগুলো এর মধ্যে অন্যতম। এই দুইটি বিষয় নিয়ে এবারের আয়োজন।
আজিজ মোল্লা একজন কৃষক। স্ত্রী রুনা বেগম এবং দুই মেয়ে মুনিরা ও মিশুকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সাত বিঘা জমিতে চাষাবাদ করে তিনি সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল। যখন আজিজ মোল্লা তাঁর বড় মেয়ে মুনিরাকে বিয়ে দেওয়ার টাকার ব্যবস্থার জন্য জমি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাঁর কাছে তিনি জমি বিক্রি করতে গেলেন তিনি আজিজ মোল্লার জমির কাগজপত্র দেখে বললেন, উত্তরাধিকারসূত্রে তুমিই জায়গার মালিক কিন্তু খতিয়ানে তো তোমার নাম নেই, আছে তোমার মৃত বাপের নাম, নামজারির মাধ্যমে তোমার নাম খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত না করলে জমি রেজিস্ট্রি করা যাবে না। আজিজ মোল্লা বুঝতে পারছিলেন না তাঁর এখন কী করতে হবে? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে খতিয়ান ও নামজারি কী তা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
খতিয়ান :
কোনো মৌজার দাগ অনুসারে ভূমির মালিকের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, মালিকানার বিবরণ, জমির বিবরণ, মৌজা নম্বর, মৌজার ক্রমিক নম্বর (জেএল নম্বর), সীমানা, জমি শ্রেণী দখলকারীর নাম, অংশ, অংশ মতে পরিমাণসংবলিত যে তালিকা বা দলিল_তাই হলো খতিয়ান। খতিয়ান মানেই এসব বর্ণিত বিষয়ের একটি সুস্পষ্ট হিসাব। একে ভূমিশুমারিও বলা যায়।
সরকার বিভিন্ন সময় খাজনা আদায়ের উদ্দেশে সারা দেশে জরিপ করে এই খতিয়ান প্রস্তুত করে। সরকারের ভূমি জরিপের মূল উদ্দেশ্য ভূমি দখলকারীর কাছ থেকে খাজনা আদায় করা। সে কারণে ভূমিতে যিনি দখলকার তাঁর নামে ভূমি জরিপ করা হয়। এই দখলকারী ওই সম্পত্তিতে কী মূলে দখলকার, তার স্বত্ব নির্ধারণ জরিপ কর্মকর্তার কাজ নয়। তাই খতিয়ান হচ্ছে দখলের প্রামাণ্য দলিল, স্বত্ব বা মালিকানার দলিল নয়। খতিয়ানে মালিক ছাড়া অন্য কারো নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে ওই ভূমিতে যেমন সেই ব্যক্তির কোনোরূপ মালিকানা সৃষ্টি হয় না, তেমনি প্রকৃত মালিকের মালিকানাও নষ্ট হয় না। কিন্তু খতিয়ান একটি সরকারি দলিল, ভূমি হস্তান্তর, খাজনা বা রাজস্ব আদায়সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
সর্বপ্রথম সার্ভে আইন ১৮৭৫ এবং বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫-এর অধীনে সরজমিনে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা জরিপ করে সিএস (Cadastral Survey) খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। একই আইনের অধীনে আরএস (Revenue Survey) প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে যথাক্রমে এসএ (State Acquisition Survey) এবং বিএস (Bangladesh Survey) খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। সিএস খতিয়ানকে বাংলাদেশি ভূমি ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
নামজারি :
ভূমি মালিকানার পরিবর্তনে সর্বশেষ খতিয়ানে নাম ও দাগসহ নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করাকে নামজারি (mutation) বলা হয়। এককথায় মূল মালিকের নাম খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করার আইনানুগ প্রক্রিয়াকে নামজারি বলা হয়। খতিয়ান হালনাগাদ করা, সংরক্ষণ ও সংশোধনের মাধ্যম হলো নামজারি করা। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০-এর ১৪৩ ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বা এডিসিকে (রেভিনিউ) নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে খতিয়ান সংরক্ষণ ও সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছেঃ
ক. রেজিস্ট্রিকৃত দলিল মূলে জমি হস্তান্তরিত হলে।
খ. ভূমি মালিকের মৃত্যু ঘটলে।
গ. সার্টিফিকেট মামলা ও কোর্ট মামলা কর্তৃক কোনো জমি নিলাম বা স্বত্বাধিকার ঘোষিত হলে।
ঘ. সরকার খাস জমি বন্দোবস্ত দিলে।
ঙ. পরিত্যক্ত হওয়া বা অধিগ্রহণ করা বা নদী সিকস্তির (ভাঙনের) কারণে খাজনা মওকুফ হলে নামজারির আবেদন করতে হয়।
কিভাবে নামজারি করবেন :
কোনো ব্যক্তি তাঁর নামে খতিয়ানে নামজারি করাতে চাইলে তাঁকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সংক্ষেপে এসির (ল্যান্ড) কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে যে দলিলের মাধ্যমে সে মালিকানা পেয়েছেন তাঁর ফটোকপি দিতে হবে। যেমন_কবলা বা আদালতের রায়ের কপি। উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক হলে ওয়ারিশ সনদপত্র দিতে হবে। অর্থাৎ গল্পের আজিজ মোল্লাকে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ওয়ারিশ সনদপত্র নিয়ে এসির (ল্যান্ড) কাছে আবেদন করতে হবে। সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ কোর্ট ফি, ভূমি উন্নয়ন কর ও নতুন খতিয়ানের জন্য ফি দেওয়া লাগবে। এসি (ল্যান্ড) তহসিলদারের কাছে আবেদনপত্রসহ পাঠাবেন, তহসিলদার দখল আছে কি না জরিপ করে এসির (ল্যান্ড) কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন। এসি (ল্যান্ড) তার ওপর ভিত্তি করে নামজারি করবেন। যদিও আইনত শুধু তিন ধরনের ফি দেওয়ার বিধান, কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, এর সঙ্গে তহসিলদার এসিকে (ল্যান্ড) অতিরিক্ত কিছু না দিলে আবেদনপত্র দেখাই হয় না অর্থাৎ ফাইল খোলা হয় না।
খতিয়ানে ভুলে অন্যের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে :
কোনো খতিয়ানে জরিপের সময় মূল মালিকের নামের পরিবর্তে ভুলে অন্য কোনো ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে মূল মালিককে খতিয়ান সংশোধনের জন্য জমির দাম অনুযায়ী উপযুক্ত আদালতে মামলা করতে হবে। আদালত খতিয়ান ভুল এই মর্মে রায় (ডিক্রি) দিলে সেই ডিক্রিমূলে খতিয়ান সংশোধনের জন্য এসির (ল্যান্ড) কাছে আবেদন করতে হবে। এমনকি সরকারি সম্পত্তি ভুলে খতিয়ানে কোনো ব্যক্তির নামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে সরকারকেও খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি আনয়ন করতে হবে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নজির হলো_’খতিয়ানসংক্রান্ত স্বত্বের প্রশ্নে একমাত্র দেওয়ানি আদালতই সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারে’ (১৫ ডিএলআর ৪৮৩)। কারণ রাজস্ব কর্মকর্তা এসির (ল্যান্ড) কোনো বিচারিক ক্ষমতা নেই। তিনি জমির স্বত্ব নির্ধারণ করতে পারেন না।
আদালতের রায় বা ডিক্রিমূলে নামজারি করতে গেলে আবেদনকারীর স্বত্বসম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি রাজস্ব কর্মকর্তা করতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ডিক্রি পাওয়ার পরও দখল ও স্বত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে রাজস্ব কর্মকর্তা আবেদনকারীকে হয়রানি করেন ও উৎকোচ প্রদানে বাধ্য করেন।
খতিয়ান সংশোধনের অন্তরায় : রাজশাহীর প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক আবদুল হান্নানের সংসার স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে। তাঁর নিজস্ব ১০ বিঘা জমির খাজনা পরিশোধ করতে তহসিল অফিসে গিয়ে দেখেন তাঁর দাগের জায়গার মালিকের নাম লেখা সরকার। আইন অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে সহকারী জজ আদালতে খতিয়ান সংশোধনের মামলা করেন। বছরের পর বছর মামলা চালানোর পর আদালত হান্নানের পক্ষে রায় দেন। আদালত খতিয়ান সংশোধনের নির্দেশ দেন।
সরকার আপিল করে, আপিলে আগের রায় বহাল রাখা হয়। এরপর আবদুল হান্নান এই রায়মূলে খতিয়ান সংশোধনের জন্য এসির (ল্যান্ড) কাছে আবেদন করেন। এসি (ল্যান্ড) তাঁকে জানান, ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০ (৩২৪ অনুচ্ছেদ) অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বা এডিসির (রেভিনিউ) অনুমতি লাগবে। অনুমতির জন্য রিপোর্ট গেলে এডিসি (রেভিনিউ) হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিশন মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ ১০ বছর রিভিশন মামলা চলার পর ২০০৯ সালে হাইকোর্টে সহকারী জেলা জজের রায় বহাল রাখেন, অর্থাৎ খতিয়ান ভুল ঘোষণা করেন। এদিকে মামলার খরচ চালাতে গিয়ে আবদুল হান্নান ঋণের ভারে জর্জরিত হন। এ ছাড়া তাঁর চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন পড়ে। জমি বিক্রি ছাড়া তিনি আর উপায় খুঁজে পান না। এসির (ল্যান্ড) কাছে আবার নামজারির আবেদন করেন।
তিনি জানান, আবার এডিসির (রেভিনিউ) অনুমোদন নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। রিপোর্টের জন্য ফাইল তহসিলদারের কাছে পাঠালে তিনি জানান, আদালতের রায়ে কী হয়, নামজারি হবে কি হবে না, তা তো নির্ভর করবে আমার রিপোর্টের ওপর। তহসিলদার একটি বড় অঙ্কের উৎকোচ দাবি করে বসেন।
আবদুল হান্নান এখন ঘোর বিপাকে। নিজের জায়গা নিজের নামে আদালতের রায় আনতেই তাঁর আয়, স্বাস্থ্য, সঞ্চয় গিয়ে তিনি এখন ঋণে জর্জরিত। আবার এত টাকা তিনি কোথায় পাবেন? ভুলক্রমে কোনো ব্যক্তির জমি ১ নম্বর খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে অর্থাৎ সরকারি খাস জমি হয়ে গেলেও তাঁকে একই পদ্ধতিতে নাম সংশোধন করতে হয়। এতে ডিক্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি অহেতুক লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হয়, আদালত এবং প্রশাসনের কাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর মূল মালিক তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আদালতের রায় মানা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও এডিসি (রেভিনিউ) অনুমোদনের জন্য অহেতুক সময়ক্ষেপণ করেন। এ-সংক্রান্ত হাইকোর্টের নজির হলো_
‘দেওয়ানি আদালতের রায় সরকার মানতে বাধ্য, যদি না তা উপযুক্ত আদালত দ্বারা বাতিল হয়’ (৪৫ ডিএলআর-৫)।
অনেক সময় সমন পাওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আদালতে হাজির হয় না। ফলে সরকারের বিপক্ষে একতরফা ডিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু সরকারের বিপক্ষে একতরফা ডিক্রি গ্রহণযোগ্য নয় বলে এডিসি (রেভিনিউ) নামজারি প্রক্রিয়া বন্ধ রেখে আপিল দায়ের করেন। যেসব কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে একতরফা ডিক্রি হয়, তাঁদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো নেওয়াই হয় না বরং ডিক্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মামলার ডিক্রির ফলভোগ হতে বিরত রাখা হয়। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যায়। সম্পত্তির অধিকার সুষ্ঠুভাবে ভোগ করার জন্য এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
Discussion about this post