গাড়ির মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
গাড়ির মামলা কি তা আগে আমাদের জানতে হবে। তাছাড়া সড়ক চলাচলের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। এসব নিয়ম না মানলে নিয়ম ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দায়িত্ব পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। বিভিন্ন নিয়মভঙ্গের কারণে পুলিশ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।
কি কি কারণে গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে? গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসমূহ।মটর সাইকেল-মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত হলে? মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত না হলে? মামলা হলে করনীয় কি? গাড়ির মামলার ধারা ও জরিমানা।গাড়ির মামলা উঠানোর নিয়ম।গাড়ি কীভাবে জিম্মায় নেবেন? বিভিন্ন ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণের লিষ্ট ইত্যাদি।
গাড়ির মামলা কি?
“ড্রাইভিং লাইসেন্স” নির্দিষ্ট শ্রেণীর মোটরযান চালানোর জন্য কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব প্রদান করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দ্বারা প্রদত্ত দলিল বা ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্ত না হয়ে যারা গাড়ি চালায় তখন সেই ব্যক্তির নিকট থাকা গাড়িটির নামে মামলা দেওয়া হয় এটাই মূলত গাড়ির মামলা। এছাড়াই আইনে উল্লেখিত আরো অনেক নিওম কানুন ভঙ্গ করলেও গাড়ির নামে মামলা করা হয় বা জরিমান করা হয় ।
কি কি কারণে গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে?
Fine for violating traffic rules & Power of arrest without warrant under motor vehicle Act 1983
আমরা দেখতে পাই ট্রাফিক আইন ভঙ্গসহ পুলিশ বিভিন্ন কারণে গাড়ি আটক করে করে থাকেন। গাড়ি আটক হলে মনে করেন গাড়িটি ছাড়িয়ে আনা বেশ ঝামেলার কাজ।সেজন্য অনেকেই আবার পুলিশকে উৎকোচ দিয়ে ঝামেলার হাত থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করে থাকেন।
পুলিশ যে সকল কারণে আপনার গাড়ি আটক করতে পারে তা হলো:-
- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো হলে।
- সঠিক জায়গায় গাড়ি পার্ক না করা হলে।
- চলাচল করতে গিয়ে পুলিশের নির্দেশনা অমান্য করা হলে।
- গাড়ির ফিটনেস সংক্রান্ত কাগজপত্র নবায়ন করা না হলে।
- ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন না করা ।
- এ ছাড়াও আইন অনুযায়ী আরো কিছু বিষয় কে কেন্দ্র করে পুলিশ আপনার গাড়ি আটক করতে পারে।
যানবাহনের ত্রুটি-যেমনঃ- যেমন হেডলাইট না জ্বলা বা না থাকা, ইন্ডিকেটর লাইট না থাকা বা না জ্বলা, সাধারণ পরিবহন/গাড়ীর বডিতে পার্টিকুলার বা বিবরণ না থাকা, মালিক বা মালিকের নাম ঠিকানা না থাকা, গাড়ীতে অতিরিক্ত আসন সংযোজন অথবা গাড়ীতে বিআরটিএ অনুমোদন ছাড়া কোন সংযোজন বা পরিবর্তন করা, ইত্যাদি কারণে যানবাহন মামলা হতে পারে।
ট্রাফিক আইন না মানা–যেমনঃ-ট্রাফিক সিগন্যাল/লাইট না মেনে গাড়ী চালানো, বিপদজনকভাবে দ্রুত গতিতে গাড়ী চালানো, যখন তখন লেন পরিবর্তন করা, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেলমেট ছাড়া মটরসাইকেল চালানো ইত্যাদি কারণে মামলা হতে পারে।
বৈধ কাগজপত্র না থাকলে– যেমনঃ- রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইন্স্যুরেন্স, সাধারণ পরিবহনের জন্য রুট পারমিট, সর্বোপরি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি না থাকলে মটরযান আইনে মামলা হতে পারে। এগুলোকে ডকুমেন্টারি মামলা বলা হয়।
গাড়ি আটক করার সময় পুলিশের করণীয়ঃ-
পুলিশ গাড়ি আটক করার সময় একটি বা দু’টি কাগজ জব্দ করে থাকেন।পুলিশ গাড়ি আটক করার সাথে সাথে আপনাকে একটি রশিদ প্রদান করেন। পুলিশের প্রদানকৃত রশিদের পেছনেই লেখা থাকবে কোন জোনের ট্রাফিক পুলিশ আপনার গাড়িটি আটক করলো। আপনাকে সেই জোনের অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে।
উক্ত প্রদানকৃত রশিদের পেছনে জোন ভিত্তিক আপনার উপস্থিতির সময় লেখা থাকবে। সে অনুয়ায়ী আপনি সেই জোনে গেলে আপনার সময় বাঁচবে বা কাজটা সহজ হবে।মনে রাখবেন আপনাকে প্রদানকৃত রশিদ বা কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট অফিসে পৌঁছাতে সাধারণত তিন-চারদিন সময় লাগে।সুতরাং আপনার ৫ দিন পরে উক্ত অফিসে যোগাযোগ করাই ভালো হবে।
কে জরিমানা করলেন? আপনার গাড়ীটি কোথায়? কি অপরাধে আপনার গাড়ীটির উপর জরিমানা করা হল? আপনাকে কত তারিখের মধ্যে হাজির হতে হবে? সকল কিছুই রশিদটিতে লিখে দেয়া থাকবে । সংশ্লিষ্ট জোনের ডেপুটি কমিশনার জরিমানা নির্ধারণের মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে থাকেন।
এই ক্ষেত্রে আপনি আপনার অনুকূলে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরতে পারবেন। ডেপুটি কমিশনার পূর্ণ জরিমানার চার ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত জরিমানা নির্ধারন পারেন, এমনকি জরিমানা সম্পুর্ণ মওকুফও করে দিতেও পারেন। জরিমানা দেবার জন্য ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের অফিস থেকে আরেকটি রশিদ আপনাকে দেয়া হবে ।
জরিমানা না দিলে বা যথাসময়ে হাজির না হলে অপরাধের ধরন, ঘটনাস্থল ইত্যাদির প্রতিবেদন সহকারে মামলাটি আদালতে প্রেরণ করা হবে এবং আপনার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করার জন্য।
জরিমানা নির্ধারনের পর আপনি যদি মনে করেন আপনার ওপর অন্যায় করা হয়েছে তাহলে আপনিও আদালতে যেতে পারেন।যদিও সামান্য জরিমানার জন্য আদালতে গিয়ে আর্থিক বিচারে আপনার কোন উপকার হবে না, তবে রায় আপনার অনুকূলে গেলে সেটি আপনার জন্য একটি নৈতিক বিজয় হতে পারে । এত ঝামেলা করে কেউ সাধারণত জরিমানা চ্যালেঞ্জ করতে আদালতে যেতে চান না।
মটর সাইকেল-মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত হলে?
মটর সাইকেল-মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত হলেও গাড়ির মালিকের নামেই মামলা হবে । গাড়ি ভাড়াই চালিতো হলে যে ড্রাইভারের লাইসেন্স রয়েছে তার কাছে গাড়ি দিয়ে ভাড়াই চালাতে পারবেন।
মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত না হলে?
মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত না হলেও গাড়ির কোন মামলা হলে গাড়ির মালিকের নামেই মামলা হবে।
গাড়ির মামলা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসমূহঃ-
মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত হলেঃ-
R/C – রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট
F/C – ফিটনেস সার্টিফিকেট
R/P – রুট পারমিট
T/T – ট্যাক্স টোকেন
D/L – ড্রাইভিং লাইসেন্স
I/C – ইন্সুরেন্স সার্টিফিকেট
মটর সাইকেলঃ-
R/C – রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট
I/C ইন্সুরেন্স সার্টিফিকেট
T/T – ট্যাক্স টোকেন
D/L – ড্রাইভিং লাইসেন্স
মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত না হলেঃ-
R/C – রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট
F/C – ফিটনেস সার্টিফিকেট
T/T – ট্যাক্স টোকেন
D/L – ড্রাইভিং লাইসেন্স
I/C – ইন্সুরেন্স সার্টিফিকেট
গাড়ির মামলা হলে করনীয় কি?
যানবাহনের যে কোন আইন ভঙ্গ করার জন্য মামলা হতে পারে। ডকুমন্টারি বা অন্য কোন কারণে মটরযান আইনে মামলা হলে সেটা বিশেষ উদ্বেগজনক কিছু নয় বা তেমন চিন্তার কোন বিষয় নয়।
একজন ডেপুটি কমশনার (ডিসি ট্রাফিক) প্রতিটি জোনের দায়িত্বে থাকেন।সুতরাং যেকোন মামলার ক্ষেত্রে আগে বিবেচনা করতে হবে সেটি কোন এলাকার আওতাভুক্ত রয়েছে। কোন ট্রাফিক বিভাগের অধীনে মামলা হয়েছে সেটা জরিমানার সময় যে টিকেট দেয়া হয় তার পেছনে লেখা থাকবে।
সংশ্লিষ্ট জোনের ডেপুটি কমিশনারের দপ্তরে গিয়ে কিছু দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে খুব সহজেই মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। এক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে জরিমানা প্রদান করতে হবে। বিচারক অথবা ডিসি ট্রাফিক জরিমানার অংক নির্ধারন করেন। জরিমানা নির্ধারনকারী পূর্ণ জরিমানার ৪ ভাগের ১ ভাগ পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন, এমনকি মওকুফও করতে পারেন। জরিমানা প্রদানের পরপরই জব্দ হওয়া ডকুমেন্ট বুঝে নেয়া দরকার।
ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জরিমানাঃ
ধারাঃ ৬৬
অপরাধের ধরণঃ
ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান ও গণপরিবহন চালনা বিধি নিষেধ সংক্রান্ত ধারা ৪ এবং ৫ এর বিধান লঙ্ঘন করলে আপনার যে শাস্তি হবে,
জরিমানাঃ
অনধিক ২৫ হাজার টাকা।
দন্ডঃ
অনধিক ৬ মাস।
ধারাঃ ৬৭
অপরাধের ধরণঃ
ড্রাইভিং লাইসেন্স হস্তান্তর সংক্রান্ত ধারা ৬ এর বিধান লঙ্ঘন করলে আপনার যে শাস্তি হবে,
জরিমানাঃ
অনধিক ৫ হাজার টাকা।
দন্ডঃ
অনধিক ১ মাস।
ধারাঃ ৬৮
অপরাধের ধরণঃ
বিদেশী নাগরিক দিয়ে এই আইন, বিধি বা প্রবিধানের কোন বিধান বা লাইসেন্স প্রদত্ত শর্ত অমান্য সংক্রান্ত ধারা ৯ এর বিধান লঙ্ঘন করলে আপনার যে শাস্তি হবে,
জরিমানাঃ
অনধিক ৩০ হাজার টাকা।
ধারাঃ ৬৯
অপরাধের ধরণঃ
কর্তৃপক্ষ ব্যতিত ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত , প্রদান বা নবায়নে বিধি নিষেধ সংক্রান্ত ধারা ১০ এর বিধান লঙ্ঘন করলে আপনার যে শাস্তি হবে,
জরিমানাঃ
অনূন্য ১ লক্ষ টাকা অনধিক ৫ লক্ষ টাকা।
দন্ডঃ
অনূন্য ৬ মাস অনধিক ২ বছর।
ধারাঃ ৭০
অপরাধের ধরণঃ
ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বাতিল করা হইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক মোটরযান চালানোর উপর বিধি নিষেধ সংক্রান্ত ১২ এর বিধান লঙ্ঘন করলে আপনার যে শাস্তি হবে,
জরিমানাঃ
অনধিক ২৫ হাজার টাকা।
দন্ডঃ
অনধিক ৩ মাস
ধারাঃ ৭১
অপরাধের ধরণঃ
ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বাতিল করা হইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক মোটরযান চালানোর উপর বিধি নিষেধ সংক্রান্ত ১২ এর বিধান লঙ্ঘন করলে আপনার যে শাস্তি হবে,
জরিমানাঃ
অনধিক ৫ হাজার টাকা
দন্ডঃ
অনধিক একমাস।
ধারাঃ ৯৬
অপরাধের ধরণঃ
মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা সংক্রান্ত ধারা ৬৩ এর বিধান লঙ্ঘন করলে আপনার যে শাস্তি হবে,
জরিমানাঃ
অনধিক ১ লক্ষ টাকা
দন্ডঃ
কর্তৃপক্ষ ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল বন্ধ করতে পারবে।
গাড়ির মামলা উঠানোর নিয়মঃ-
ওয়ারেন্ট–নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মামলা নিস্পত্তি না করা হলে ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা প্রেরণ করা হয়। আদালত থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যুর পর পুলিশ কর্মকর্তাগণ রাস্তায় সংশ্লিষ্ট গাড়িটি আটক করে এবং ওয়ারেন্ট ইস্যুর পর গাড়িটি ছেড়ে দেয়।
গাড়ি কীভাবে জিম্মায় নেবেন?
ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তি:–
ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তির কাজটিও কঠিন নয়। ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তির পর জন্য ওয়ারেন্ট নম্বরটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোর্টে হাজির হয়ে GRO এর মাধ্যমে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়।
পরিশেষে যেহেতু সড়ক চলাচলের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। এসব নিয়ম না মানলে নিয়ম ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দায়িত্ব পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। বিভিন্ন নিয়মভঙ্গের কারণে পুলিশ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।তাই আমাদের জানতে হবে গাড়ির মামলা কি?
কি কি কারণে গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে? গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসমূহ।মটর সাইকেল-মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত হলে? মাইক্রো/কার/বাস ভাড়ায় ব্যবহৃত না হলে? মামলা হলে করনীয় কি? গাড়ির মামলার ধারা ও জরিমানা।গাড়ির মামলা উঠানোর নিয়ম।গাড়ি কীভাবে জিম্মায় নেবেন? বিভিন্ন ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণের লিষ্ট ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের সকলের বিস্তারিত জেনে রাখা একান্ত জরুরী।
লেখকঃ ল ফর ন্যাশনস, ইমেইলঃ lawfornations.abm@gmail.com, মোবাইল: 01842459590.
আইন সম্পর্কে আরো জানতে বিডি ‘ল’ নিউজ এর সঙ্গেই থাকুন ধন্যবাদ
আরো জানতে ক্লিক করুন ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করার নিয়ম ও ফি সম্পর্কে বিস্তারিত
Discussion about this post