অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান:
নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট এর বিধান মতে চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কিছু না কিছু ধারনা থাকা উচিত। কেননা এ আইনে মামলা দায়েরের পদ্ধতি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। দৈনন্দিন জীবনে চেকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চেক প্রতারণার ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি চেকের মেয়াদ কতদিন, তা কতবার নগদায়নের জন্য উপস্থাপন করতে হয়, তা ডিজঅনার হওয়ার কতদিনের মধ্যে নোটিশ দিতে হয় কিংবা মামলা করতে হয় ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকেই প্রতারকের হাতে কষ্টার্জিত অর্থ হারিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকছেন। আমাদের দেশে সার্বজনীন আইন শিক্ষা না থাকায় আইন অজ্ঞতা হেতু আমরা প্রতিনিয়ত ঠক্ছি, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। অথচ আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন আছে। তার সঠিক প্রয়োগের অভাবে অনেকেই নিঃস্ব হচ্ছেন। অনেকে লেনদেনের ক্ষেত্রে নগদ টাকা দিয়ে চেক ফেরৎ নেন না। কিংবা চেক হারিয়ে গেলে/ নষ্ট হলে থানায় জি,ডি ও ব্যাংকে ষ্টপ পেমেন্ট ইত্যাদি করেন না কিংবা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার বা প্রয়োজনীয় আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। এতে দেখা যায় টাকা আদায় করা সত্বেও তার বিরুদ্ধে চেকের মামলা হচ্ছে। আবার দেখা যায় চেক প্রদানকারী উল্টো টাকা ‘প্রাপকের’ বিরুদ্ধে চেক উদ্ধারের মামলা করছেন। অর্থাৎ আইন অজ্ঞতার এবং অসচেতনতার কারণে একদিকে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি দন্ড ভোগ করেন, তেমনি আবার অনেকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হন। সুতরাং এতদসংক্রান্তে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা জনস্বার্থে জরুরী মনে করছি।
আমাদের দেশে চেক ডিজঅনারের মামলার পদ্ধতি সম্পর্কে বহু ভুল ধারণা রয়েছে। ফলে দেখা যায় পদ্ধতিগত কারণে অনেকের মামলার অধিকারই নষ্ট হয়ে যায়। চেকের মামলা করতে ৩ (তিন) বার চেক ডিজঅনার করাতে হয় মর্মে একটি ভুল ধারণা আমাদের দেশে সর্বসাধারণে প্রচলিত রয়েছে। অনেক বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ও অভিজ্ঞ ব্যাংক কর্মকর্তাকেও দেখেছি চেকের মামলার জন্য গ্রাহককে ৩ বার চেক ডিজঅনার করানোর পরামর্শ দিতে। এটা একটা প্রচলিত নিয়মে পরিনত হয়েছে। যা একটা অত্যন্ত ভুল পরামর্শ। প্রকৃত পক্ষে আইনে এ ধরণের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এ ব্যাপারে এন.আই এ্যাক্টের বিধান মতে চেক ৬ মাসের মধ্যে যেদিন ডিজঅনার হবে সে দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে লিগ্যাল ডিমান্ড নোটিশ প্রদানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। একাধিকবার ডিজঅনার করানোর ব্যাপারে আইন টি সম্পূর্ণ নিরব।
একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা না থাকার দরুন চেক ডিজঅনার হলে ফৌজদারী আইনে তার শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ব্যাপারে ১৮৮১ সালের নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট এ কতিপয় ধারা সংযোজিত/ সংশোধিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ১৯ নং আইন বলে উক্ত আইনের ১৩৮ হতে ১৪৪ ধারায় চেক ডিজঅনারের বিধি বিধান আলোচিত হয়েছে। পরবর্তীতে ২০০০ সনের ১৭ নং আইন এবং ২০০৬ সালের ৩নং দ্বারা এ অধ্যায়টি অধিকতর সংশোধনী আনা হয়েছে।
কোন ব্যক্তি যদি তার কোন ঋণ বা দায় হতে অব্যাহতি পেতে তার ব্যাংক একাউন্ট হতে পাওনাদার ব্যক্তিকে কোন পরিমাণ টাকা প্রদানের জন্য চেক কাটেন বা ইস্যু করেন কিন্তু চেকটি নগদায়নের জন্য উপস্থাপন করা হলে ব্যাংক কর্তৃক চেকটি ডিজঅনার হয়ে ফেরত আসে তাহলে নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্টের ১৩৮ ধারার বিধান অনুযায়ী দেনাদারের বিরুদ্ধে ফৌজদারী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে সরাসরি মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়। ১৪০ ধারায় ফার্মের অংশীদার ও কোম্পানীর সংশ্লিষ্ট পরিচালকগণ চেক প্রতারণার মামলায় আসামী হবেন।
চেক ডিজঅনারের মামলায় কতিপয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়:-
চেকের মেয়াদ: চেকে প্রদত্ত তারিখ হতে এর মেয়াদ ৬ (ছয়) মাস। এ ছয় মাসের মধ্যে কমপক্ষে একবার কিংবা সুষ্পষ্ট কারণে একাধিকবার উক্ত চেক নগদায়নের জন্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। নূন্যতম ১ বার ডিজঅনার হওয়ার কথা বলা হয়েছে বেশী কতবার তা সীমা বর্ণিত না হলেও ৬ মাসের মধ্যে যতবার ইচ্ছা করা যায়। তবে এর যথেষ্ঠ কারণ থাকতে হবে। কোন অজুহাত ছাড়া বার বার চেক ডিজঅনার করা যাবে না।
যে দিন চেকটি ডিজঅনার হয়েছে সে তারিখ থেকে বা সর্বশেষ ডিজঅনারের তারিখ থেকে ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারী ব্যক্তি বা ফার্মকে চেকের টাকা পরিশোধের জন্য ফেরৎ রশিদ সহ রেজিষ্ট্রার্ড লিগ্যাল ডিমান্ড নোটিশ প্রদান করতে হবে। ধারকের পক্ষে তার আইনজীবী কিংবা চেকটির ধারক (হোল্ডার) নিজেও উক্ত নোটিশ দিতে পারেন। তবে এখানে সতর্ক থাকতে হবে যেন নোটিশটির আইনগত ত্র“টি না থাকে। কেননা এটি পরবর্তীতে মামলা দায়েরের ভিত্তি হবে। তাই চেকের মামলা সম্পর্কে অভিজ্ঞ আইনজীবী হতে পরামর্শ গ্রহণ করা উত্তম। বর্তমান সংশোধিত বিধান মতে ৩ ভাবে নোটিশ দেয়া যায়- (১) সরাসরি নোটিশ হস্তান্তরের মাধ্যমে (২) রেজিঃ ডাক যোগে লিখিত নোটিশ (৩) দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে। নোটিশে চেকের উল্লেখিত টাকা পরিশোধের জন্য চেক প্রদানকারী ব্যক্তি কিংবা ফার্মকে নোটিশ প্রাপ্তির দিন হতে টাকা আদায়ের জন্য ৩০ (ত্রিশ) দিন সময় দিতে হবে। দেনাদারের সর্বশেষ জানা সঠিক ঠিকানায় নোটিশ দিলে তা প্রাপক গ্রহণ না করলে, ফেরত আসলে/ প্রত্যাখান করলে তাতে মামলার কোন ক্ষতি হবে না। তবে আইনের বিধান হচ্ছে লিখিতভাবে নোটিশ দিতেই হবে এবং নোটিশে প্রাপককে টাকা আদায়ের জন্য নোটিশ প্রাপ্তির দিন হতে ৩০ (ত্রিশ) দিন সময় দিতে হবে। এর আগে মামলা করা যাবে না। নোটিশ গ্রহণ বা প্রত্যাখানের দিন থেকে উক্ত সময় গননা হবে।
নোটিশটি গৃহীত কিংবা প্রত্যাখান হওয়ার তারিখ হতে ১(এক) মাস অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে সি,আর, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। ডাক বিভাগের অনিয়ম এবং অবহেলার কারণে এ/ডি ফেরত না আসলে বা প্রাপকের কোন জবাব পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে নোটিশ প্রেরণের তারিখ হতে ৩০(ত্রিশ) দিন পর পরবর্তী ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। মামলা দায়েরের সময় প্রসংগে দি নেগোশিয়েবল ইন্সষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্টের ১৪১ ধারার বিধান রয়েছে।
সূত্র: (ক) (৫১ ডিএলআর (এডি) ১৯৯৯নং পৃষ্ঠা ২১৮ (এসএম, আনোয়ার হোসেন বনাম মোঃ সাইফুর আলম গং) এ সকল বিষয়ে মামলার আর্জিতে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দিতে হয়। নোটিশ পাওয়ার ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারী চেকের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে নোটিশের ৩০ দিনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ থেকে মামলার কারণ বা ‘‘কজ অব এ্যাকশন’’ শুরু হয়।
(খ) “A complaint for an offence under section 138 can be filed within one month from the date of cause of action. The cause of action starts from expiry of 30 days form the date of service of notice to the accused.’’ (Venu vs. Krishnappa, (1992)2 Crimes 542)”
সুচতুর প্রতিপক্ষ (দেনাদার) মামলার ‘‘কজ অব এ্যাকশন’’ নষ্ট করতে কিংবা চেকের মেয়াদ পার করিয়ে দিতে বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করতে পারে। এজন্যে এ ব্যাপারে পাওনাদারকে সতর্ক থাকতে হয়। অবশ্য চেকের মেয়াদ চলে গেলেও দন্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ইত্যাদি ধারায় প্রতারণার মামলা করা যায়। ৪০৬ ধারাটি জামিন অযোগ্য হয়। দন্ডবিধির উক্ত ধারা ২(দুই)টি যে কোন প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্টের ২০০৬ সালের সংশোধনী ১৮৮১ সালের দি নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্টের (১৮৮১ সালের ২৬ নং আইন) এর অধিকতর সংশোধনীর লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ৯নং আইন দি নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্টের (সংশোধনী) অনুযায়ী subsection 1 এর clause (b) ও (c) মতে চেক ডিজঅনার হওয়ার ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে চেকের লেখক (Drawer) বরাবরে নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধের জন্য লিখিতভাবে লিগ্যাল নোটিশ দিতে হবে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী subsection (1) এর subsection (1A) সংযোজনের মাধ্যমে চেক ডিজঅনারের নোটিশ জারীর তিনটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। পদ্ধতি তিনটি হচ্ছে- ১) যার নিকট নোটিশ জারী হবে তার নিকট ডেলিভারী প্রদানের মাধ্যমে অথবা ২) প্রাপ্তি স্বীকার পত্র সহ প্রাপকের দেশে ও বিদেশের ঠিকানায় রেজিষ্ট্রারী ডাকযোগে প্রেরণের মাধ্যমে অথবা ৩) বহুল প্রচারিত জাতীয় বাংলা দৈনিকে প্রকাশের মাধ্যমে। এছাড়াও সংযোজিত ১৩৮ (এ) তে বলা আছে ডিজঅনারকৃত চেকের ৫০ শতাংশ অর্থ জমা প্রদান ব্যতিরেকে অত্র আইনের কোন শাস্তির আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না।
১৩৮ ধারার সীমাবদ্ধতা: নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট এর ১৩৮ ধারা শুধু মাত্র ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। চেক ডিজঅনারের মামলায় সঠিক সময়ে চেক ডিজঅনার না করা, সঠিক সময়ে নোটিশ প্রেরণ না করা ও সঠিক সময়ে আদালতে নালিশ দায়ের না করায় মামলাটি প্রাথমিকভাবে খারিজ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ বিজ্ঞ আদালত মামলাটি এ সকল কারণে আমলে গ্রহণ না করতে পারেন। নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্টের ১৩৮ ধারার মামলায় উল্লেখিত সময় বা দায়েরের মেয়াদ কোন অবস্থাতেই কিংবা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে হ্রাস বৃদ্ধি করা যায় না।
নালিশের সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু: চেক ডিজঅনারের মামলায় নালিশের দরখাস্তে বাদী ও অভিযুক্ত/ আসামীর পরিচয়, চেক লেনদেনের সংক্ষিপ্ত ঘটনা, ঘটনার তারিখ, মামলার ধারা, চেকের তারিখ, একাউন্ট নং, ব্যাংকের নাম, শাখা, চেকের নাম্বার, চেকের টাকার পরিমাণ ইত্যাদি পরিস্কার ভাবে উল্লেখ করতে হয়। তাছাড়া চেক ডিজঅনার হলে ব্যাংকের স্লিপে not arranged for/ refer to drawer/ Insufficient Funds ইত্যাদি যে কোন মন্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ থাকতে হয়। নোটিশ প্রাপক নোটিশ পাওয়ার জবাবে তার প্রদত্ত স্বীকৃতি বা সর্বশেষ অস্বীকৃতি ইত্যাদিও আর্জিতে উল্লেখ করতে হয়। একটি গ্রহণযোগ্য ভালো আর্জি বাদীর (অভিযোগকারীর) মামলা প্রমাণে সমর্থ হয়। আর্জিতে লেনদেনের কারণ উল্লেখ না করলে দেনাদার চেকখানা মিসিং হয়েছে মর্মে মিথ্যা ডিফেন্স নিতে পারে। এজন্যে আর্জিতে স্বাক্ষীর নাম এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দালিলিক প্রমাণ থাকলে তাও দায়ের করতে হয়। তবে চেকের মামলায় অভিযুক্তের স্বাক্ষরিত চেকই প্রমাণের জন্য যথেষ্ঠ। চেক প্রদান করে একাউন্ট বন্ধ করে
দেয়াও আরেকটি প্রতারণা।
কোন আদালতে মামলা হবে: ইতিপূর্বে মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণীর হাকিমের আদালতে ১৩৮ ধারার চেক ডিজঅনারের শাস্তিযোগ্য অপরাধের মামলা দায়ের ও বিচার হতো। বর্তমানে ২০০৬ সালের সংশোধিত আইনে অভিযোগটির বিচার হবে দায়রা জজ কোর্টে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের হলে বিজ্ঞ ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে শুনানীর পর শপথপাঠে বাদীকে পরীক্ষা করে জবানবন্দি নিয়ে শুনানী অন্তে সরাসরি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সমন/ ওয়ারেন্ট জারী করতে পারেন। তিনি মামলা ভিত্তিহীন হলে কিংবা পদ্ধতিগত ত্র“টির কারণে প্রাথমিকভাবে খারিজ করতে পারেন। আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অভিযোগ ছাড়া উক্ত আইনের ১৩৮ ধারায় অপরাধের অভিযোগ আমলে নিবেন না। সেশন জজ আদালতের অধঃস্তন কোন আদালত ১৩৮ ধারায় কিংবা এন,আই,এ্যাক্ট এর কোন অপরাধের বিচার করতে পারবেন না।
চেক ডিজঅনারের মামলার টাকা কে পাবেন: সর্বশেষ সংশোধনী মতে ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনারের মামলায় অপরাধীর শাস্তি হলো সর্বোচ্চ এক বৎসর মেয়াদের যে কোন মেয়াদে কারাদণ্ড অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত পরিমাণ অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ড প্রদান। চেকে উল্লেখিত টাকার যতটুকু জরিমানা হিসেবে আদায় হবে তা চেকের বাহক বা ধারককে প্রদান করা হবে। কেননা এটা অন্যান্য ফৌজদারী মামলায় জরিমানার শাস্তি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। বিজ্ঞ বিচারিক আদালত চেকের মামলায় জরিমানার টাকা আদায়ে জেলা কালেক্টর বা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারী কৌশলী মারফত দেওয়ানী আদালতে জারী মামলা দায়ের করতে হয়। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ ধারার বিধান মতেও জরিমানা দন্ড প্রাপ্ত অপরাধীর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয় পূর্বক জরিমানা আদায়ের জন্য পরোয়ানা জারী কিংবা খেলাপকারীর স্থাবর বা অস্থাবর বা উভয় প্রকার সম্পত্তিতে দেওয়ানী পদ্ধতি অনুযায়ী পরোয়ানা কার্যকর করে জরিমানার টাকা আদায়ের কর্তৃত্ব দিয়ে জেলার কালেক্টরকে পরোয়ানা দিতে পারবেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪৭ ধারাও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তবে টাকা আদায়ের পদ্ধতি আরো সহজ করা দরকার। যাতে প্রতারকরা আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে। টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখা যেতে পারে। মূল আইনে টাকা আদায়ের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় সংশ্লিষ্টদের মারাত্মক বিড়ম্বনা ও হয়রানির শিকার হতে হয়। এছাড়াও চেকের ধারক তার অনাদায়ী অর্থ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সহ আদায়ের জন্য দেওয়ানী আদালতে মামলার অধিকার রাখে। তবে মনে রাখতে হবে দেওয়ানী আদালতে টাকা আদায় এর মামলা সর্বশেষ লেনদেনের ৩ (তিন) বছরের মধ্যে করতে হয়। কোন কোম্পানীর চেক ডিজঅনার হলে অপরাধ সংগঠনের সময় উক্ত কোম্পানীর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরত কর্মকর্তা (পরিচালকগণ) উক্ত অপরাধের শাস্তিভোগ করবেন। তবে ঘটনা সম্পর্কে কোন জ্ঞানই ছিলনা এরূপ কোন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া যায় না। কোম্পানী বা এসোশিয়েশন কর্তৃক প্রদত্ত চেক ডিজঅনার হলে নেগোশিয়েবল ইনষ্ট্রুমেন্ট এ্যাক্টের ১৪০ ধারা প্রযোজ্য হবে। উক্ত আইনের ধারা সমূহ জামিনযোগ্য ও দ্রুত বিচারযোগ্য।
চেক প্রতারণায় তথা এন,আই এ্যাক্টের মামলা সরাসরি থানায় দায়ের করা যায় না। তা সরাসরি ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হয়। আইনটি কোন কোন ক্ষেত্রে অপব্যবহারও হচ্ছে। টাকা আদায়ের পরও জামানত স্বরূপ প্রদত্ত চেক ব্যবহার করে হয়রানির শিকার করা হচ্ছে অনেককে। এন.আই এ্যাক্টে জরিমানার অর্থ আদায়ে আইনী দূর্বলতার কারণে প্রকৃত প্রতারকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া চেকের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নির্দিষ্ট আদালতকে দায়িত্ব দিতে হবে যাতে উক্ত আদালতের উপর অন্য কোন মামলা মোকাদ্দমার দায় দায়িত্ব না থাকে। এজন্য আইনটি আরো শক্তিশালী ও যুগপোযোগী করা জরুরী, তবে ব্যবসায়ী, অর্থলগ্নিকারী ও পাওনাদারদের স্বার্থ রক্ষায় উক্ত আইনের বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা দরকার। এ ব্যাপারে বিচারক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের বিশেষ প্রশিক্ষণ (ওরিয়েন্টেশন) ও কর্মশালার মাধ্যমে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখা যায়।
লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, কলামিষ্ট
Discussion about this post