দুই বোতল ফেনসিডিলের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে আবার আড়াইশ বোতল ফেনসিডিলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিতে দেখছি’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা কেন বাড়ানো হবে না- দুদকের করা এই আবেদনের ওপর শুনানিতে হাইকোর্ট এ মন্তব্য করেন।
আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন খুরশীদ আলম খান। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এ জে মোহাম্মদ আলী ও জয়নুল আবেদীন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
শুনানির শুরুতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, মামলার প্রধান অভিযুক্ত খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া হয়েছে পাঁচ বছর। অথচ সহযোগীদের দেয়া হয়েছে ১০ বছর। আইনের দৃষ্টিতে এটা বৈষম্যমূলক।
তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয়েছে যে আত্মসাতকৃত টাকার পরিমাণের কথা বিবেচনা করেই এ সাজা দেয়া হয়েছে। রায়ের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে যে, যখন টাকা এসেছিল তখনকার হিসাবে এটা অনেক টাকা। যদিও বর্তমানে বাজার মূল্যে এটা কম। তাই খালেদা জিয়াকে কম সাজা দেয়া হয়েছে।
দুদকের আইনজীবী বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারক স্ববিরোধী যুক্তি দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনদের ৫(২) ধারার অভিযোগ প্রমাণ পেলেও সাজা দেয়া হয়নি। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর আসামিদের এ ধারায় সাজা দিলে দুদকের সংক্ষুব্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সাজা দিয়েছে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায়। সকল আসামিকে সমপরিমাণ সাজা দিলে আমরা সংক্ষুব্ধ হতে পারতাম না।
এ সময় আদালত প্রশ্ন করেন- ৫(২) ধারায় যদি একজনকে চার বছর আর অন্যদের সাত বছর সাজা দেয়া হতো তখন কী করতেন? জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, তখন দেখা যেতো।
আদালত বলেন, আমাদের দেশে সাজা দেয়ার ব্যাপারে কোনো নীতি নেই। সুনির্দিষ্ট আইন নেই। আমরা দেখছি যে, দুই বোতল ফেনসিডিলের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে। আবার আড়াইশ বোতলের মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হচ্ছে।
আদালত শুনানিতে দুদকের আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেন, খালেদা জিয়া মামলার মূল অভিযুক্ত হওয়ার পক্ষে কী প্রমাণ আছে? দুদক আইনজীবী বলেন, নিম্ন আদালতের রায়েই তা বলা আছে। এছাড়া এভিডেন্স রয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে টাকা এসেছে। ১৯৯৩ সালে এ টাকা দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত তা ব্যবহার না করে ফেলে রাখার মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। নিম্ন আদালতের রায়ে এটা বলা হয়েছে।
কেন আপিল না করে রিভিশন আবেদন করলেন এ বিষয়ে আদালতের প্রশ্নের জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, আসামিকে খালাস দিলেই কেবল দুদক আপিল করতে পারে। অন্যথায় আপিল করতে পারে না। এ কারণে শুধুমাত্র সাজা বাড়াতে রিভিশন আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর শারীরিক অসামর্থ, বয়স্ক মহিলা, একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এগুলো বলে তাকে (খালেদা জিয়াকে) ক্ষমা করার সুযোগ নেই।
আদালত তার কাছে জানতে চান যে পুরো রায়ের বিরুদ্ধে এ আবেদন কি না? জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, না। দুদক পুরো রায় চ্যালেঞ্জ করেনি। শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর জন্যই রিভিশন আবেদন করেছে।
শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সাজা বাড়ানো দাবির বিরোধিতা করে বলেন, দুদক আইন একটি বিশেষ আইন। এ আইনে রিভিশন আবেদন করার সুযোগ নেই। দুদক কেবল আপিল আবেদন করতে পারে। তাও যদি কোনো আসামিকে খালাস দেয় সেক্ষেত্রেই কেবল দুদকের আপিল করার এখতিয়ার রয়েছে। যেহেতু খালেদা জিয়াকে নিম্ন আদালত খালাস দেয়নি, তাই দুদকের রিভিশন আবেদন করার এখতিয়ার নেই।
তিনি বলেন, এ আইনের রিভিশন আবেদন করতে হলে আইন জাতীয় সংসদে সংশোধন করতে হবে। আপনারা হয়তো মনে থাকার কথা যেমনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইন (জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র পক্ষের আপিল আবেদন করার সুযোগ সৃষ্টির জন্য আইসটি আইন জাতীয় সংসদে সংশোধন করা হয়।)
এ সময় আদালত বলেন, আদালতের রিভিশন করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এটা কীভাবে ব্যবহার করবে তা বলা নেই। জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকার বা দুদক খালেদা জিয়ার সাজা বাড়াতে চায়। তাই তারা আগে আইন সংশোধন করে আসুক। তিনি দুদকের আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করার আবেদন জানান।
আদালত বলেন, আপনারা দুইপক্ষই আইনের প্রশ্ন তুলছেন। তাই এটার সুরাহা হওয়া দরকার। খালেদার অপর আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, আইনে একটি মাত্র দরজা। আর তাহলো আপিল করা। রিভিশন করার এখতিয়ার নেই। আইনে দুদককে সে সুযোগ দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, এটা বিশেষ আইন হওয়ায় সিআরপিসি কার্যকর হবে না। তাই দুদকের রিভিশন আবেদন করার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা রয়েছে। কিন্তু বিশেষ পরিকল্পনায় দুদক খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদন করেছে। এটা খারিজ যোগ্য। আসলে দুদক আপিল করতে লজ্জা পাচ্ছে। এ কারণেই ভুল পথে এসেছে।
এরপর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, দুদক একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা কারও বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে দুদক সেটা করেছে। দুদকের আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালতের দেয়া সাজা বাড়াতে দুদক রিভিশন আবেদন করতে পারে না। নিম্ন আদালতের সাজার ব্যাপারে তাদের সংক্ষুদ্ধ হওয়ার কিছু নেই। দুদক ভুল পথে এসেছে। তাই দুদক তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা কেন বাড়ানো হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্র ও খালেদা জিয়াকে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।একইসঙ্গে, সাজা বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার করা মূল আপিলের সঙ্গে সাজা বাড়ানোর জন্য জারি করা এই রুলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
Discussion about this post