বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মালিকানা সুরক্ষায় বেশকিছু আইন আছে। তারমধ্যে পেটেন্ট একটি। কিন্তু আমাদের দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের চর্চাকারী তথা উদ্ভাবকেরা পেটেন্ট সম্পর্কে অনেকাংশেই সচেতন নন বলে পরিলক্ষিত হয়। ফলে এই সংক্রান্ত আইনটির প্রয়োগও তেমন দেখা যায় না। তাই বলে কী আপনি আপনার উদ্ভাবনের পেটেন্ট করবেন না? নিশ্চয়ই করবেন। আসুন আজ জেনে নেই পেটেন্ট সম্পর্কিত কিছু তথ্যঃ
পেটেন্ট কি?
পেটেন্ট হচ্ছে একচেটিয়া অধিকার, কোনো কিছু উদ্ভাবনের জন্য এটা অনুমোদন করা হয়। উদ্ভাবনটি হতে পারে একটি পণ্য বা একটি প্রক্রিয়া যা কোনো কিছু সম্পাদনের নতুন পদ্ধতি প্রদান করে বা কোনো সমস্যার নতুন কারিগরী সমাধান প্রস্তাব করে। একটি পেটেন্ট, এর মালিককে তার উদ্ভাবনের সুরক্ষা প্রদান করে। সীমিত সময়ের জন্য এই সুরক্ষা বলবৎ থাকে, সাধারণত ২০ বছর পর্যন্ত।
পেটেন্ট সুরক্ষার অর্থ হচ্ছে পেটেন্ট মালিকের অনুমতি ছাড়া তার উদ্ভাবনটি বাণিজ্যকভাবে তৈরি, ব্যবহার, বিতরণ বা বিক্রি করা যাবে না। পেটেন্ট সংশ্লিষ্ট অধিকারগুলো সাধারণত কার্যকর করেন আদালত। আবার, আদালত তৃতীয় কোনো পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে একটি পেটেন্টকে অবৈধও ঘোষণা করতে পারেন।
পেটেন্ট মালিকের কি অধিকার রয়েছে?
পেটেন্টকৃত উদ্ভাবনটি অনুমোদিত সময়ের মধ্যে কে বা কারা ব্যবহার করতে পারবে বা কারা পারবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার একজন পেটেন্ট মালিকের রয়েছে। পেটেন্ট মালিক পারস্পারিকভাবে সম্মত কোনো চুক্তির মাধ্যমে অন্য কোনো পক্ষকে তার উদ্ভাবনটি ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন বা লাইসেন্স প্রদান করতে পারেন। এছাড়া পেটেন্ট মালিক তার উদ্ভাবনটির অধিকার অন্য কারও কাছে বিক্রিও করতে পারেন, যার কাছে বিক্রি করবেন তিনি হবেন ঐ পেটেন্ট’র নতুন মালিক। পেটেন্ট’র মেয়াদ শেষ হলে এর সুরক্ষাও শেষ হয় এবং উদ্ভাবনটি তখন জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত হয়ে যায়, অর্থাৎ এর উপর মালিকের একচেটিয়া অধিকার আর থাকে না, অন্যরা নিজেদের সুবিধা মতন কাজে লাগিয়ে বানিজ্যকভাবে সেটা ব্যবহার করতে পারে।
কোন ধরনের উদ্ভাবনগুলো সুরক্ষা করা যায়?
পেটেন্ট’র মাধ্যমে সুরক্ষিত হতে হলে একটি উদ্ভাবনকে অবশ্যই কিছু শর্তপূরণ করতে হবে। উদ্ভাবনটির বাস্তবিক ব্যবহার থাকবে; এতে থাকবে অভিনব কিছু উপাদান, অর্থাৎ নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য যেগুলো ওই কারিগরি ক্ষেত্রে বিদ্যমান জ্ঞান ভান্ডারে অপরিচিত। বিদ্যমান জ্ঞান ভান্ডারকে বলা হয় ‘প্রায়র আর্ট’(Prior Art)। একটি উদ্ভাবনে অবশ্যই থাকতে হবে একটি উদ্ভাবনকুশল পদক্ষেপ বা ধাপ যেন গড়পড়তা জ্ঞানসহ সংশ্লিষ্ট কারিগরি শাখার কেউ তা অনুমান করতে না পারেন। চুড়ান্ত বিচারে, আইন অনুসারে এর বিষয়বস্তু ‘পেটেন্টযোগ্য’ বলে স্বীকৃত হতে হবে। অনেক দেশেই সাধারণত বৈজ্ঞানিক তত্ব, গাণিতিক পদ্ধতি, উদ্ভিদ বা প্রাণীর ভিন্ন প্রজাতি, প্রাকৃতিক বস্তু আবিষ্কার, বাণিজ্যিক পদ্ধতি বা চিকিৎসা সেবার পদ্ধতি (চিকিৎসা সামগ্রী ব্যতিত) পেটেন্টযোগ্য নয়।
পেটেন্ট কিভাবে মঞ্জুর করা হয়?
পেটেন্ট লাভের প্রথম ধাপটি হচ্ছে একটি পেটেন্ট আবেদনপত্র দাখিল করা। এই আবেদনপত্রে সাধারণত উদ্ভাবনের নাম ও কোন কারিগরী শাখায় এটা প্রযোজ্য সে বিষয়ক তথ্য থাকে। তাছাড়া আবেদনপত্রে উদ্ভাবনটির পটভূমি ও এর বিস্তারিত বিবরণ স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করতে হয়, যেন ওই নির্দিষ্ট বিষয়ে গড়পড়তা ধারণা সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এটা ব্যবহার করতে পারেন বা পুনরুৎপাদনে সক্ষম হন। বিবরণের পাশাপাশি বিষয়টি আরো বোধগম্য করতে দৃষ্টিগ্রাহ্য উপাদান যেমন ড্রয়িং (Drawing), পরিকল্পনা (Plan) বা ডায়াগ্রামও (Diagram) প্রদান করতে হয়। আবেদনপত্রে আরো থাকে বিভিন্ন ধরনের ‘দাবি’, অর্থাৎ এমন সব তথ্য যা পেটেন্ট-এর মাধ্যমে মঞ্জুরকৃত সুরক্ষার মেয়াদ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
কে পেটেন্ট অনুমোদন করে?
পেটেন্ট মঞ্জুর করে জাতীয় পেটেন্ট অফিস বা আঞ্চলিক পেটেন্ট অফিস। আঞ্চলিক পেটেন্ট অফিস অনেকগুলো দেশের হয়ে কাজ করে, যেমন ইউরোপীয় পেটেন্ট অফিস (EPO) এবং আফ্রিকান মেধা সম্পদ সংস্থা (OAPI)। এধরণের আঞ্চলিক পদ্ধতিতে, একটি মাত্র আবেদন পত্রের মাধ্যমে এক বা একাধিক দেশে পেটেন্ট সুরক্ষার অনুমতি প্রার্থনা করা যায় এবং প্রত্যেকটি দেশ তাদের ভূখন্ডে সুরক্ষার আবেদন গ্রহণ করবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। WIPO পরিচালিত পেটেন্ট সহযোগিতা চুক্তি (Patent Cooperation Treaty) এক্ষেত্রে একটি মাত্র আন্তর্জাতিক আবেদনপত্র দাখিলের সুবিধা প্রদান করে, যেটা অনেকটা নিজ দেশের পেটেন্ট অফিসে আবেদন করার মত। সুরক্ষা পেতে আগ্রহী কোনো আবেদনকারী একটি মাত্র আবেদন দাখিল করতে পারেন এবং যতগুলো দেশ সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে তার সবগুলো দেশে তিনি সেটা সুরক্ষার অনুরোধ জানাতে পারেন।
লেখকঃ
মসনদ বিন তৈফুর (নিলয় ভূঁইয়া)
সদস্যঃ ঢাকা ট্যাক্সেস বার এ্যাসোসিয়েশন
বাংলাদেশ কোম্পানি ল’ প্র্যাক্টিশনার’স সোসাইটি।।
Discussion about this post