১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কেটেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও মিমন স্কুলে। পরবর্তীতে কলারোয়া পাইলট হাইস্কুল থেকে ২০০০ সালে এসএসসি এবং শেখ আমানুল্লাহ কলেজ থেকে ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০০২-২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আইন বিভাগে। ২০০৬ সালে এলএলবি (সম্মান) এবং চাকুরিকালিন সরকারের অনুমতি নিয়ে এলএলএম ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্পেশাল মাস্টার্স পাস করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হতে না হতে সাময়িক সনদপত্র দিয়ে ২০০৮ সালে ৩য় বিজেএস (২০০৭ সালে আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস হওয়ার পরে প্রথম বিজেএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৮ সালের ২২মে সহকারি জজ হিসেবে যোগদান করেন।
চাকরি জীবনে তিনি ঢাকা, খুলনা, মেহেরপুর, ঠাকুরগাঁও ও ঝিনাইদহ আদালতে বিভিন্ন বিভাগে সম্মান ও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমানে বিচারক (যুগ্ম জেলা জজ) ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, ঝিনাইদহ হিসেবে কর্মরত আছেন। এই বছর ২২ মে চাকুরি জীবনের একযুগ পূর্ণ হবে বিচারক মো.তাজুল ইসলামের।
ঝিনাইদহের যুগ্ম জেলা জজ (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল) হিসেবে নিজের মেধা, শ্রম, বিচক্ষণতা এবং মানসিকতায় দৃঢতা দিয়ে শুনানি করেন বলেই তিনি গতবছর (২০১৯ সালে) এবং করোনা সংকটের আগ পর্যন্ত ২০২০ সালে- মোট ১৫ মাসে প্রায় ২০০০টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।
দেশের অন্যতম সফল এই বিচারক সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছেন বিচার বিভাগ নিয়ে অনেক অজানা গল্প। বিচার বিভাগে সফলতা অর্জন করতে হলে কি করতে হবে, মামরাজট কমানোর উপায়সহ নানা ইতিবাচক কথাই উঠে এসেছে তার কথায়। একই সঙ্গে শুনিয়েছেন নিজের স্বপ্ন ও সফলতার গল্প।
প্রশ্ন : আপনার এতো দ্রুত বিচারের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি কাজ করে?
মো. তাজুল ইসলাম : ন্যায় বিচার পাওয়া সকলের সাংবিধানিক অধিকার। আমাদেরকে রাষ্ট্র বেতন দেয় জনগণের সেবার জন্য, তাদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য। এটা আমাদের শুধু সাংবিধানিক দ্বায়িত্ব নয় বরং নৈতিক দ্বায়িত্ব। ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যেমন আমি গুরুত্বের সাথে করি তেমনি মামলার অন্য নথিপত্রগুলো নিয়ে অফিস সময়ের বাইরে ঘাঁটাঘাটি করি, বাদি-বিবাদি পক্ষদ্বয়ের আচরণসহ সংশ্লিষ্ট আইন নিয়ে পড়াশুনা করি। এভাবে আইনের ভেতর থেকে আইনি প্রতিকার সকলের জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করার চেষ্টা থাকে। বাদি-বিবাদির মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কষ্ট- এর পাশাপাশি আইনগত যে দ্বায়িত্ব তা আমাকে দ্রুত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সাহস যোগায়।
প্রশ্ন : কিভাবে দ্রুত মামলা নিস্পত্তি করেন?
মো. তাজুল ইসলাম : বিচার প্রক্রিয়ায় আইন,আইনজীবী বা বিচারকরাই শুধু ভূমিকা পালন করে না, বরং বাদি-বিবাদি পক্ষের উপর তা অনেকাংশে নির্ভর করে। আদালতের প্রত্যেক কর্মচারির ভূমিকাও এতে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মামলা জট নিরসন করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা আমরা নিয়ে রেখেছি; কিন্তু তারপরও মামলা জট কমানো যাচ্ছে না। কর্মজীবনের শুরু থেকেই এই বিষয়টি নিয়ে আমার যথেষ্ট ভাবনা ছিলো। এ কারণেই সবার সহযোগিতায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। আদালতের সকল কর্মচারি, বাদি-বিবাদি পক্ষসহ আইনজীবীদের আন্তরিকতায় দ্রুত মামলা নিস্পত্তি হচ্ছে। সবার আন্তরিকতা আর ভালোবাসা অর্জন ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : ন্যায় বিচার অনেক কথা-বার্তাই হয়। আবার ভুক্তভোগিদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ন্যায় বিচার পাননি। মূলতঃ ন্যায় বিচার বলতে আসলে কি কি বোঝায়?
মো. তাজুল ইসলাম : সাধারণ জনগণ যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে যেন তার প্রতিকার হয়, পাশাপাশি যে অপরাধি তার শাস্তি ও সংশোধনের ব্যবস্থাই সহজ কথায় ন্যায় বিচার। আপনি শুধুমাত্র অধিকার ফিরিয়ে দেবেন; কিন্তু যে অধিকার নিচ্ছে তার শাস্তি দিবেন না তাহলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে না। যার যা আইনত প্রাপ্ত, শাস্তি বা প্রতিকার তা নিশ্চিত করাই ন্যায় বিচার। আর আইনের দৃষ্টিতে ন্যায় বিচারের আলাদা ব্যাখ্যা সেগুলোও মানতে হয়। ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তিটি ন্যায়বিচারের জন্য যথেষ্ঠ এবং আমি তা মেনে চলি এবং ন্যায়বিচার বলতে আমিও সেটি বুঝি।
প্রশ্ন : আইনের শাসন, বিচারে প্রবেশাধিকার এই বিষয়গুলোকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মো. তাজুল ইসলাম : ধরুন, একটি আইন তৈরি করা হলো- বিচারকরা চাইলেই যে কারো সাজা ঘোষণা করতে পারে বা এমন বলা হলো বিচারকরা যা বলবে তাই চূড়ান্ত। এই আইনের মাধ্যমে শাসন করে যদি বলা হয়, এটাই আইনের শাসন তাহলে তো হয় না। আইনের শাসন বলতে বুঝায় জনবান্ধব ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যে আইন ও আইনের প্রয়োগ। আর বিচারে প্রবেশাধিকার বলতে বুঝায় আপনি যদি কারো মাধ্যমে অধিকার থেকে বঞ্ছিত হন বা কেউ আপনার ক্ষতি করে তাহলে আপনার মামলা করার অধিকার। আপনি কারণ তৈরি হলে মামলা করতে পারবেন। আর আদালত সাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ন্যায় বিচার দিবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে বিচার বিভাগ কি স্বাধীন?
মো. তাজুল ইসলাম : আপনাকে একটি গাড়ির লাইসেন্স দিয়ে বলা হলো আপনি গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে স্বাধীন। এখন আপনি কি যেমন-তেমন গাড়ি চালাবেন, নাকি কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চালাবেন? কিছু নিয়মের মধ্যে থাকা স্বাধীনতার হরণ নয়। বরং তা মঙ্গলজনক। বাংলাদেশ সংবিধানের ২২নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহি বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে। ১১৬ ক অনুচ্ছেদে আমরা দেখতে পাই বিচার বিভাগ স্বাধীন অবস্থায় আছে। অনেকেই মনে করে, বিচার বিভাগ স্বাধীন অবস্থায় নাই; কিন্তু এটা তো সত্য নয়। বিচার বিভাগ স্বাধীন বলেই ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে কারো হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমি এতো রায় দিতে পেরেছি।
প্রশ্ন : আদালতে বিচার কাজের পর বাকি সময় কেমন করে কাটান?
মোঃ তাজুল ইসলাম : অফিসের পর যে সময়টুকু পাই, তা পরিবারকে দেই। এর বাইরে প্রতিদিন কোন না কোন আইনের নতুন বিষয় শেখার চেষ্টা করি। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখালেখি করি। আর মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে একটু কাজ করি। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আরো পড়াশুনা করি, মামলার শুনানিকালীন সময়গুলো মনে করা, এসব নিয়েই সময় চলে যায়।
প্রশ্ন : একজন বিচারককে কি কঠোর নাকি নরম হওয়া প্রয়োজন?
মো. তাজুল ইসলাম : বিচারক তো সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী রায় দেবেন। এখানে তার নরম বা কঠোর হওয়ার তেমন কোন অবকাশ নেই। তবে বিচারককে যেহেতু আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে, তাই তার জন্য আইন জানা ও প্রয়োগবিধি বোঝা বেশি জরুরি। এই প্রয়োগবিধির ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা খুব বেশি কাজ দেয়। বিচারককে তাই হতে হবে আইন বিশ্লেষক ও গবেষক। যে আইনের তথ্য আর বাস্তবতা সমন্ধে ভালো জ্ঞান রাখবে এবং নিজের বিচারের জায়গায় হবে সৎ আর দৃঢ। বিচারক আইন ও তার বাস্তবতা অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করবে। তার আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত।
প্রশ্ন : মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে আপনার পরামর্শ কি?
মো. তাজুল ইসলাম : বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইনের ওপর গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে। তাদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করাতে হবে, যাতে তারা জনগণকে আইন সমন্ধে সচেতন করতে পারে। পাশাপাশি মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আইনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা দিলে জনগণ আরো বেশি সচেতন হতে পারবে এবং আদালত সমন্ধে তাদের ভীতি দূর হয়ে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। জনগণ যদি তাদের দ্বায়িত্বের জায়গায় সৎ আর সচেতন হয়, তাহলে অনেক মামলা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। মামলার পক্ষ বিপক্ষও অনেক সময় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে চায় না। আইনজীবী এবং বিচারকদের মাঝে যদি কোন ঘাটতি থাকে- তা দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব; কিন্তু জনগণ সচেতন না হলে এসব তেমন কোন কাজে আসবে না। জনগণের সচেতনতা আগে তৈরি করতে হবে। পাশাপশি বারবার টাইম পিটিশন, আপিল, রিভিউ, রিভিশন ইত্যাদির বিধানগুলো সহজ প্রক্রিয়ায় আনতে হবে।
প্রশ্ন : পেশা হিসেবে বিচারককে কিভাবে দেখেন?
মো. তাজুল ইসলাম : প্রথমত আমি এই কাজকে পুরোপুরি সেবা হিসেবে দেখি। সমাজে শৃঙ্খলা আনতে আইন ও তার সঠিক প্রয়োগ অবশ্যই দরকার। এতে যদি সামান্য বিচ্যুতি ঘটে তাহলে সমাজের কাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব শুরু হয়। যার কুফল সব মানুষের উপর পড়ে। ডাক্তাররা একজন ব্যাক্তির রোগ সারাতে ভূমিকা রাখে; কিন্তু বিচারবিভাগ পুরো সমাজের রোগ সারাতে পারে। আমি এবং আমাদের বিচার বিভাগ সেই কাজ যতেষ্ঠ আন্তরিকতার সাথে করছি। বিচারবিভাগে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আশা করি বিচার বিভাগ তার সকল প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে। জনগণের ও সমাজের সেবা করার এই পেশা আমার কাছে গর্বের।
প্রশ্ন : বিচার বিভাগের কোন কোন সমস্যা আছে বলে আপনার মনে হয়?
মো. তাজুল ইসলাম : আপনাকে এর আগেও কিছু কিছু বিষয় বলেছি। আইনজীবী বা বিচারকরা অনেক আন্তরিকতার সাথে মামলার নিষ্পত্তি করতে চাইলেও মামলার পক্ষগণ অনেক সময় তাতে আন্তরিক থাকে না। অনেকেই ব্যক্তিগত জেদের বশে মামলা করে বছরের পর বছর ধরে সেটা চালায়। গ্রামের বা এলাকার কিছু দালাল টাইপের ব্যক্তিরা এর থেকে সুবিধা পায় বলে তারা পক্ষগণকে এই কাজে উৎসাহিত করে।
জনগণের কাছে যদি আইন ও আইনের বিষয়ে সহজ জানার মাধ্যম থাকতো তাহলে নাগরিক সচেতনতা বিচার বিভাগের কাজের গতি আরো দ্রুত করতো। আমাদের আইনগুলোর কিছু কিছু সংশোধনি আনলে ভালো হয়। অধিকাংশ আইন, যেগুলো আদালতে প্রায়ই প্রয়োগ করা হয় তা ব্রিটিশ আমলের তৈরি করা। তাই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে তার পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা জরুরি। বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি জোরদার বরতে হবে। যে সকল আদলতের নিজস্ব কোন স্টাফ আজও নিয়োগ হয়নি সে সকল কোর্ট-এ দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হবে। বিচারক নিয়োগ ও বিচার বিভাগে বিচারকের অপ্রতুলতা দূর করতে হবে। বিচারকদের জন্য রাষ্ট্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট আন্তরিক। তাই বিচারকরাও তাদের সর্বোচ্চটা দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশে বিচার বিভাগের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। খুব দ্রুত আমরাও আমাদের ছোটখাট দূর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠবো।
প্রশ্ন : দেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন এবং কোন বিষয়টি পাল্টে দিতে খুব ইচ্ছে হয়?
মো. তাজুল ইসলাম : দেশ নিয়ে অনেকের মতো আমারও স্বপ্ন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া এই বাংলাদেশ নারি-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ আবাসভূমি হবে, সেই স্বপ্ন সবসময় দেখি। তাই মনে হয়, আমাদের দেশে যদি সব কিছু আইন মেনে চলতো! সবাই যদি করোনার সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতো তাহলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করোনামুক্ত দেশ গড়ে উঠতো। এ ছাড়া যদি সুযোগ থাকতো, তাহলে একটি বিষয় পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেটা হচ্ছে, মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস ভীতি ভয়ানক রকমের ইনটলারেন্স বাড়ার কারণে যে অশান্তি ও সংকট চলছে সারা বিশ্বজুড়ে, সেটি পাল্টে দিতে ও আগের মতো শান্ত পৃথিবী দেখতে খুব ইচ্ছে হয়।
Discussion about this post