আমাদের দেশে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে আজও আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। কিন্তু আজও দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত এবং নিজ পরিবারে সহিংসতার শিকার। নারীদের সুরক্ষার জন্য অনেকগুলো বিশেষ আইন রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকেরই এই আইনগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই অনেক সময় বুঝতে পারেন না তারা কোথায় যাবেন বা কী করবেন। যার ফলে তারা প্রতিনিয়ত ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
শারীরিক বা অর্থনৈতিক নির্যাতন সামনে এলেও মানসিক নির্যাতন অনেকটাই আড়ালে রয়ে যায়। কারণ বাইরে থেকে শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোনো দাগ থাকে না। এক জরিপে দেখা গেছে, স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৬৫ শতাংশ নারী। আর মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ মানসিক নির্যাতনের পরিমাণ বেশি। কিন্তু মানসিক নির্যাতন কোনটিকে বলা হবে আর কোনটিকে বলা হবে না, সেটি এই সমাজের কাছে স্পষ্ট নয়। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন বিবাহিত নারীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের একটি গবেষণায় নারীদের দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তাদের ওপর নির্যাতনকে দায়ী করেছে।
এখন নিশ্চয় প্রশ্ন উঠবে মানসিক নির্যাতন কী?
কোনটা কোন মানুষের জন্য মানসিক নির্যাতনের কারণ আর কোনটা নয়, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে চাকরি করতে বাধা দেওয়া, বাইরের মানুষের সামনে কথা শোনানো, পুরুষতান্ত্রিক আচরণ দিয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা, সন্দেহ করা, চলাচলে বাধা দেওয়া, ভয় দেখানো, অবজ্ঞা/ অপমান করা- এসব আচরণ করে নারীকে মানসিক নির্যাতন করা হয়। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে এই বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে মামলাও করা যায়। কিন্তু মামলা করার হার মাত্র ৩ শতাংশ।
নারীর ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দুই-তৃতীয়াংশই হয় পারিবারিকভাবে। একজন নারী পারিবারিকভাবে মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। অন্যদিকে, শিশুদের প্রতিও পারিবারিকভাবে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান যুগে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি অভিভাবকদের আসক্তিও শিশুর প্রতি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানের উপর অধিকার চর্চা করতে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে সন্তানকে মানসিক নির্যাতন করে থাকেন। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলেও অনেক সময় সৎ মা অথবা সৎ বাবা কর্তৃক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো শিশু প্রতিবন্ধী হলে দেখা যায়, সমাজের লোকজনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অবহেলার শিকার হয় যা তাকে মানসিকভাবে চরম হতাশাগ্রস্ত করে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচিত হয়ে আসছে। যার ফলে জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ এবং ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ এই দুইটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। অপরদিকে, স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের সংবিধানে নারী ও শিশুদের সম-অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার প্রদান করা হয়। অনেক দেরিতে হলেও এই ২টি আন্তর্জাতিক আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ও সাংবিধানিক অঙ্গীকার রক্ষায় সরকার ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনটি প্রণয়ন করেন। এই আইনটি সম্পর্কে এখনও অধিকাংশ মানুষ জানে না। সুতরাং আইনটির ব্যাপকহারে ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও
সুরক্ষা) আইন, ২০১০
এই আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা বলতে নারী বা শিশুর উপর চার(৪) ধরণের নির্যাতনকে বুঝানো হয়েছে। প্রথমে-শারীরিক নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন হচ্ছে এমন কোন কাজ বা আচরণ যার মাধ্যমে নারী বা শিশুর জীবন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা শরীরের ক্ষতি হয় বা সম্ভবনা থাকে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে-মানসিক নির্যাতন। মানসিক নির্যাতন হচ্ছে মৌখিক নির্যাতন , অপমান, অবজ্ঞা , ভীতি প্রদর্শন , ব্যক্তি স্বাধীনতায় বাঁধা । তৃতীয়টি হচ্ছে-যৌন নির্যাতন। যৌন নির্যাতন হচ্ছে যৌন প্রকৃতির এমন আচরণ যার দ্বারা নারী ও শিশুর সম্ভ্রম, সম্মান বা সুনামের ক্ষতি হয়। চতুর্থটি হচ্ছে-আর্থিক ক্ষতি। আর্থিক ক্ষতি বলতে বুঝানো হয়েছে সম্পদ বা সম্পত্তি লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা বা নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রদান না করা।
এই আইনের ১১ ধারা ও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা বিধিমালা ২০১৩ এর ৮ বিধি অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তাদের পক্ষে কোন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোন ব্যক্তি বিধিতে উল্লেখিত ‘চ’ নং ফর্ম পূরণপূর্বক একজন আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিকারের জন্যে আদালতে আবেদন করতে পারেন। এই আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী যে স্থানে আবেদনকারী বা প্রতিপক্ষ বসবাস করেন বা পারিবারিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে বা সংক্ষুব্%