বিডিলনিউজ: ১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। এই আইনের একটি ধারার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের আপিল করার অধিকারকে হরণ করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে নিম্ন আদালতের যে কোন দণ্ডাদেশ কমানো বা বাড়ানোর বিষয়ে উচ্চতর আদালতে আপিলের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে লঘুদণ্ডের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। খোদ অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী দলের প্রধান সমন্বয়ক এম কে রহমান এটিকে আইনের অসম্পূর্ণতা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এই অসম্পূর্ণতা দূর করতে আইন সংশোধন করার সুযোগ এখনো রয়েছে। এদিকে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের দাবি উঠেছে। সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, যে কোন দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রেখে অবিলম্বে আইন সংশোধন করতে হবে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবনসহ মোট ৪৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এর মধ্যে গণহত্যা ও ধর্ষণের সহায়তার তিনটি পৃথক অভিযোগে (অন্যের সহযোগী) একক দায়িত্ব হিসাবে মোট ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে দেশের প্রচলিত আইনে কোন মামলায় কারোর যদি যাবজ্জীবন বা অন্যকোন দণ্ড হয়, ওই দণ্ড বাড়ানোর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের আপিলের অধিকার রয়েছে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে দণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে লঘু দণ্ড হিসাবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এই দণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আপিল করার সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (সংশোধিত) আইনের ২১ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যে কোন অপরাধে দোষী একজন ব্যক্তি এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত একজন ব্যক্তি যে কোন সাজা ও দণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের অধিকার রাখে। খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরকারের আপিলের অধিকার রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ মনে করেন, দণ্ড কমাতে আসামির আপিলের সুযোগ থাকলেও সাজার মাত্রা বাড়াতে আপিলের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত ব্যক্তি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। আর খালাস পেলে সরকার তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে।
দণ্ডাদেশ বাড়ানোর জন্য আপিলের সুযোগ না থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, ৬টি অভিযোগের মধ্যে যে একটি অভিযোগে কাদের মোল্লা খালাস পেয়েছেন তার বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। এর সমর্থনে বলা হচ্ছে, সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্পূর্ণ ন্যায় বিচারের জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপিল বিভাগ সম্পূর্ণ ন্যায় বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজন, সেরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করতে পারবে।’ জেল হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্পূর্ণ ন্যায় বিচারের জন্য আপিল বিভাগের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগ সরকারের সেই আবেদন গ্রহণ করেনি। বর্তমানে জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্টের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল আবেদনের উপর শুনানি চলছে। এছাড়া সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘ শুধু আইন অনুযায়ী চলতে হবে।’ এ কারণে সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২১ ধারায় সংশোধন আনতে হবে। কেননা এই ধারার মাধ্যমে লঘুদণ্ডের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের আপিল করার অধিকার হরণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়,
আইনের এই ত্রুটির কারণে আপিল করা নিয়েও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। আইনে বলা আছে, ‘শুধু ট্রাইব্যুনালের খালাস আদেশের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করতে পারবে।’ এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, যেহেতু এখানে আসামি দণ্ড পেয়েছে, সেহেতু এক্ষেত্রে সরকার পক্ষের আপিলের সুযোগ নেই। আপিল করতে পারবেন কাদের মোল্লা। অন্যদিকে তার এই বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এডভোকেট এম কে রহমান। তিনি বলেন, ছয়টি অভিযোগের মধ্যে একটি থেকে কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছে। যে অভিযোগটিতে কাদের মোল্লা খালাস পেয়েছেন, সেই অভিযোগের ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, আইনে বলা হয়েছে, খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। সেটা এক অভিযোগও হতে পারে, আবার পূর্ণ খালাসও হতে পারে। তবে অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আপিল হয় কোনো মামলার রায়ের বিরুদ্ধে। কোনো একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ নেই। আইনে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, শুধু খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। তারা বলেন, সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই আইনটিকে সংশোধন করতে পারে। এ প্রশ্নে এম কে রহমান বলেন, ৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়নের পর ২০০৯ এবং ২০১২ সালে সংশোধন করা হয়। যুগের চাহিদা অনুযায়ী যে কোন সময়ে আইন সংশোধন হতে পারে। আমি মনে করি সরকার কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে দেখতে পারে।সূত্র:সালেহউদ্দিন,ইত্তেফাক
Discussion about this post