ডেস্ক রিপোর্ট
সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারকারীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী, জেলা পরিষদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধির স্বজন রয়েছেন।
ভারতে নারী পাচারে জড়িত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও যশোরের ৪৩ জন মানব পাচারকারীর বিষয়ে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের কেউ পাচারকারী চক্রের হোতা, কেউ পৃষ্ঠপোষক আর কেউ সদস্য। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারীদের নানা ফাঁদে ফেলে পাচার করেন তাঁরা।
পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, তিন জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হওয়া নারীদের ভারতের ছয় রাজ্য—পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, কেরালা, কর্ণাটক ও উত্তর প্রদেশে পাঠানো হয়। এসব রাজ্যের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, ম্যাসাজ পারলার ও স্পা সেন্টারে রেখে তাঁদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়।
ভারতে নারী পাচারের ছয় মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, সাতক্ষীরার কালিয়ানি ধাবকপাড়া এবং যশোরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে নারীদের পাচার করা হচ্ছিল।
এই চক্রের মূল ঘাঁটি বেঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়। পাচারের শিকার নারীদের সেখানে নেওয়ার পর মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। এসব ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাঁদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হয়।
■ বাংলাদেশে এই চক্রের ২০ জন এবং ভারতে ১১ বাংলাদেশিসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ■ দেশে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত মে মাসের শেষ দিকে ভারতের বেঙ্গালুরুতে এক বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপর এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে ভারত ও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ এবং ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করতে তথ্য আদান–প্রদান করে। বাংলাদেশে এই চক্রের ২০ জন এবং ভারতে ১১ বাংলাদেশিসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তাঁদের জবানবন্দিতে পাচারের রুট থেকে শুরু করে চক্রের আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে। সারা দেশেই পাচারকারী চক্রের সদস্যরা সক্রিয়। সীমান্ত এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এই চক্রে সক্রিয় আছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, ভারতে নারী পাচার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত তালিকায় ঝিনাইদহের ১৮, সাতক্ষীরার ১০ এবং যশোরের ১৫ জন রয়েছেন। তালিকায় ঝিনাইদহের জেলা পরিষদের সদস্য কে এম হেলারিংকে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাচারকারী চক্রের সদস্যদের আশ্রয় দেন। এ ছাড়া ঝিনাইদহে আরও দুজন পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন। তাঁরা হলেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের আবদুর রাজ্জাক এবং ঝিনাইদহ সদরের টিটো। এ বিষয়ে কে এম হেলারিং প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নারী পাচারে জড়িত নন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
ঝিনাইদহের অন্য ১৫ জন মানব পাচারকারীর মধ্যে সদরের ৪ জন, শৈলকুপার ৪ জন, হরিণাকুণ্ডের ৩ জন, কোটচাঁদপুরের ২ জন, কালীগঞ্জের ১ জন এবং মহেশপুরের ১ জন রয়েছেন।
এদিকে তালিকায় থাকা সাতক্ষীরার ১০ জন মানব পাচারকারীর মধ্যে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ড সদস্য রোকসোনা পারভীনের স্বামী গোলাম রসুলের নাম রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সাতক্ষীরা থেকে কলকাতা পর্যন্ত নারীদের পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি স্থানীয় মানব পাচারকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। একজন নারীকে সাতক্ষীরা থেকে কলকাতা পৌঁছে দিতে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেন।
নারীদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, কেরালা, কর্ণাটক ও উত্তর প্রদেশে পাঠানো হয়। সেখানে আবাসিক হোটেল, ম্যাসাজ পারলার ও স্পা সেন্টারে তাঁদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়।
এ বিষয়ে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য রোকসোনা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী নারী পাচারের মামলায় চার মাস জেল খেটে কয়েক দিন আগে কারাগার থেকে বেরিয়েছেন। তিনি মানব পাচারে জড়িত নন। তাঁকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে।
সাতক্ষীরার তালিকায় থাকায় অন্য ৯ জনের মধ্যে ৬ জন কলারোয়ার, ২ জন শ্যামনগরের এবং ১ জন তালা উপজেলার বাসিন্দা। অপর দিকে যশোরের ১৫ জনের মধ্যে শার্শার ৯ জন, বেনাপোলের ৫ জন এবং ঝিকরগাছার ১ জন রয়েছেন।
এদের বাইরে দুই দেশের পাচারকারীদের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবে নদী আক্তার নামের এক নারীর নাম এসেছে। তাঁর স্বামী রাজীব একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি বন্দুকযুদ্ধ নিহত হন।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের অপরাধীরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র গড়ে তুলেছে। এই চক্রের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতে গ্রেপ্তার ১১ বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
র্যাবের তথ্যমতে, পাচার হওয়া ১০ হাজারের বেশি নারী এখন ভারতে অবস্থান করছেন। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে তাঁরা কাজ করছেন।
সুত্র প্রথম আলো
Discussion about this post