ডেস্ক রিপোর্ট
ঢাকা শহরে অবস্থানের শর্তে জামিন নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা জোবায়ের মনির। কিন্তু সেই শর্ত মানেনি তো বটেই, উল্টো ঈদের সময় দলবেঁধে গ্রামের বাড়ি গিয়ে নৌকায় করে হাওড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। একে প্রমোদ ভ্রমণ বলেও আখ্যা দিয়েছেন অনেকে।
এ নিয়ে হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। গত কোরবানির ঈদে দেশজুড়ে তো বটেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও আলোচনার অন্যতম ইস্যু ছিল জামিনে থাকা আসামির এই প্রমোদ ভ্রমণ। এছাড়া বছরজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রভাবও ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
পরে গত ৯ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামিনের শর্ত ভাঙায় মানবতাবিরোধী মামলার আসামি জোবায়ের মনিরের জামিন বাতিল করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।অসুস্থতা দেখিয়ে আদালত থেকে জামিন নিয়ে নৌবিহারে যাওয়ায় তার জামিন বাতিল চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।
তিনি বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে জামিন আবেদন করার পর আসামিকে সাতটি শর্তে জামিন দেয়া হয়েছে। জামিনের অন্যতম শর্ত ছিল তিনি রাজধানীর মুহাম্মদপুরে ছেলের বাসায় থাকবেন। কোনো সাক্ষী ও মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে কাউকে প্রভাবিত করতে পারবেন না। এরকম সাতটি শর্ত দিয়ে তার জামিন মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু তিনি জামিন নেয়ার পর শর্ত ভঙ্গ করে সুনামগঞ্জে নৌবিহারে গিয়ে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন।’
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর গণহত্যা চালায় রাজাকাররা। একই সময়ে পেরুয়াসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় শ্যামারচর বাজারের পাশে মরা সুরমা নদীতে মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় পানিতে।
পেরুয়ায় গণহত্যার শিকার পরিারের সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ‘পেরুয়ায় গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনে নেতৃত্ব দেন শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল খালেকের ভাই মুকিত মনির ও কদর আলী, তার ছেলে প্রদীপ মুনির ও জোবায়ের মুনিরসহ শতাধিক লোক। আবদুল খালেক না থাকলেও এলাকায় এখনো প্রভাবশালী তার পরিবার। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না।’
২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর পেরুয়া গণহত্যা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোয় ‘পেরুয়াবাসীর স্বজন হারানোর দিন আজ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর মানুষজন মুখ খুলতে শুরু করেন।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি লিখিত অভিযোগ দেন পেরুয়া গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা রজনী দাস। এরপর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এই গণহত্যার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। একপর্যায়ে এই গণহত্যায় যুক্ত থাকা ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর জোবায়ের মনির, জাকির হোসেন, তোতা মিয়া, সিদ্দিকুর রহমান, আবদুল জলিল, আবদুর রশিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৯ সালের ১৭ জুন রজনী দাসের করা মামলায় জোবায়ের মনিরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুর হোসেন।
জোবায়ের মনির অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ঢাকা শহরে নিজ বাসায় অবস্থান করবেন, শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারবেন না’সহ আরো কিছু শর্তে ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন নিয়েছেন। কিন্তু তিনি জামিনের সেই শর্ত ভেঙে ঈদের আগের দিন শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে যান। ঈদের দিন পশু কোরবানি দিয়েছেন। এরপর নিজের লোকজনকে নিয়ে নৌকা ও স্পিডবোটে করে এলাকায় ঘুরেছেন।

করোনার প্রভাব ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে
বৈশ্বিক মহামারি করোনা এবং একজন বিচারক অসুস্থ থাকার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ, অভিযোগ গঠন ও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়ার পর্যায়ে রয়েছে। তবে, এবার কোনো মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেননি। তবে বিভিন্ন মামলায় জামিন আবেদন নিষ্পত্তিসহ অন্যান্য বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে ৩৬টির বেশি মামলা রয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় ঘোষণার পরে ওইসব রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদগুলো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এমন আপিল রয়েছে ২০টিরও বেশি।
প্রসিকিউটররা জানান, দেশের আদালতের কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু হলেও গত ৮ আগস্ট থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমও শুরু হয়। শুধু জামিন শুনানিসহ মামলাগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্কসহ অন্যান্য আইনি বিষয়ের জন্য নতুন করে শুনানির তারিখ নির্ধারণ হচ্ছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য, জব্দ তালিকা শনাক্তকরণ, ব্যক্তির সাক্ষ্য, আসামিদের গ্রেফতারি পরোয়ানা সংক্রান্ত আবেদন ও আদেশ এবং জামিন শুনানি হচ্ছে ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের এক বিচারক দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ট্রাইব্যুনালের বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের অন্তত ২৫ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় সাক্ষীদের ঢাকায় এনে সাক্ষ্য নেয়ার মতো পরিস্থিতি না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারকাজ ধীরগতিতে হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটররা।
Discussion about this post