সাত সমুদ্র, তেরো নদী পার করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সুনাম কুড়ালেও বাড়ির পাশে ভারতের বাজারে সহজে প্রবেশাধিকার নেই বাংলাদেশি পণ্যের। ফলে দেশটির বিশাল বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় যেন কুড়িয়ে পাওয়া পয়সার মতো। নিজ দেশের সোয়া ১০০ কোটিরও বেশি মানুষের চাহিদা মেটাতে গত অর্থবছর (২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত) ৪৫ হাজার ৫৯ কোটি ডলারের পণ্য অন্য দেশ থেকে কিনেছে ভারত। তার মধ্যে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে কিনেছে মাত্র ৪৬ কোটি ডলারের পণ্য। ঢাকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানিকারকদের মতে, ভারতও চায় দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ুক। এ জন্য মাদক ও অস্ত্র বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে দেশটি। কিন্তু এই বিশাল সুবিধা কোনো কাজেই আসছে না দেশটির তরফ থেকে বহাল রাখা নানা অশুল্ক বাধার কারণে। আলোচনার টেবিলে নানা সময়ই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাধাগুলো দূর করতে ভারতকে অনুরোধ করা হলেও কোনো ফল মেলেনি। এসব অশুল্ক বাধা দূর করতে এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে সরাসরি অনুরোধ ও দাবি দুটিই করবে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরই ভারত একমাত্র দেশ, যেখানে অস্ত্র ও মাদক বাদে বাংলাদেশের সব পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা রয়েছে। কিন্তু ভারতে এ সুবিধা কাজে লাগাতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। ফলে প্রতিবছর ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি বাড়লেও সে মাত্রায় রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এ কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ঘাটতি আকাশ ছুঁয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির সফর উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ২৯ কোটি ডলারের মতো। ওই বছর ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছিল ২২৩ কোটি ডলারের পণ্য। সাত বছর পর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৬ কোটি ডলারে।
সেখানে ভারত থেকে আমদানি বেড়ে হয়েছে ৬০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৯৪ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫৮ কোটি ডলারে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ভারতে আমরা তামাক ও অ্যালকোহল জাতীয় ২৫টি পণ্য ছাড়া সব পণ্য রপ্তানি করতে পারি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়লেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে অনেক ধরনের অশুল্ক বাধাও রয়েছে। এগুলো দূর করতে মূল সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনা হবে এবং এসব সমস্যা দূর করা হবে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারত তার আমদানির মাত্র ১ শতাংশের ১০ ভাগের এক ভাগ পণ্য নেয়। কিছু সমস্যার কারণে অনেক শুল্কমুক্ত পণ্য ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সমস্যা দূর করতে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি উভয় দেশের সীমান্তে কাস্টমসের ঝামেলা দূর করতে হবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন একটি দ্বিপক্ষীয় এসপিএস (স্যানেটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানেটারি) বিষয়ক চুক্তি। এটা উভয় দেশের মধ্যে হতে পারে অথবা চাইলে সার্কের আওতায় সাফটার মাধ্যমে আঞ্চলিক চুক্তিও করা যেতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও ভারতে রপ্তানি না বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাতে ছয়টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করবে ঢাকা। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত বেশির ভাগ স্থলবন্দরে ভারতীয় অংশে কোনো ওয়্যারহাউস নেই। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির উদ্দেশ্যে পাঠানো পণ্য বন্দরে কাস্টমস সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখতে হয়। এতে রোদ-বৃষ্টিতে সেই পণ্যের বিপুল অংশই নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) শাখার কর্মকর্তারা বলেন, ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পণ্যমানের সনদদাতা বিএসটিআইয়ের সনদ আমলে না নেওয়া। অর্থাৎ বিএসটিআইয়ের সনদপ্রাপ্ত বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রপ্তানি করা হলে ওই পণ্য বিনা পরীক্ষায় গ্রহণ করে না ভারত। ওই সব পণ্যের নমুনা ডাকযোগে পাঠানো হয় ভারতের ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস) কর্তৃপক্ষের কাছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবার ওই সনদ পাঠায় স্থলবন্দরগুলোয়। তারপর বাংলাদেশি পণ্য ছাড় হয়। এতে এক মাস থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। আর এর পুরো সময় বাংলাদেশি পণ্য থাকে স্থলবন্দরগুলোর ভারতীয় অংশে খোলা আকাশের নিচে। ফলে অনেক পণ্য পচে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। ২০০০ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে মান পরীক্ষার এ পদ্ধতি গ্রহণ করে ভারত। সিমেন্ট, স্টিল টিউবস, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স পণ্য, স্টিল ও রড এবং চামড়াজাত পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রয়োগ করছে ভারত।
বাংলাদেশের বিএসটিআইয়ের সনদ গ্রহণ করে বাংলাদেশের পণ্য ছাড়করণের ব্যাপারে বহুবার অনুরোধ করা হলেও তাতে সাড়া দেয়নি ভারত। নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ভারত সফরে এ বিষয়ে জোর দেবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিএসটিআই ও ভারতের বিআইএসের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনাও রয়েছে মোদির উপস্থিতিতে।
বাংলাদেশের পাটের ব্যাগ বা বস্তার বিপুল চাহিদা রয়েছে ভারতে। দেশটি মোট যে পরিমাণ পাটের বস্তা আমদানি করত, তার ৯০ ভাগই যেত বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু ২০০২ সালের ১২ জুলাই ভারতের পাট কমিশনার আমদানি করা পাটের বস্তার গায়ে প্রিন্ট আকারে ‘ব্যাগ মেইড ইন-কান্ট্রি অব অরিজিন’ লেখাযুক্ত স্টিকার লাগানো বাধ্যতামূলক করে শর্ত জারি করে। অর্থাৎ যে পাট দিয়ে বস্তাটি তৈরি করা হয়েছে, সেই পাটের মূল উৎসস্থলের নাম থাকতে হবে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, পাটের বস্তার গায়ে উৎসস্থল হিসেবে ‘বাংলাদেশ’ লেখা হলে জটিলতার শেষ হয় না। কারণ ওই পাট যে বাংলাদেশে উৎপাদিত, তার প্রমাণপত্রও দরকার হয় তখন, যা পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ২০০২ সালে শর্তারোপের পর থেকেই ভারতে বাংলাদেশের পাটের বস্তার রপ্তানি কমে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, পাটের বস্তা ছাড়া প্যাকেজিংয়ের অন্য কোনো পণ্যের ওপর এ ধরনের শর্তারোপ করেনি ভারত। তাহলে শুধু পাটের বস্তার ক্ষেত্রে কেন এ ধরনের শর্তারোপ করা হলো, তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যাও বাংলাদেশকে জানায়নি ভারত।
আবার বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ওষুধের সুনাম থাকলেও ভারতের বাজারে রপ্তানি তত সহজ নয়। এ ক্ষেত্রেও বড় কারণ একটি শর্ত। ভারতের ড্রাগস কন্ট্রোলারের নেতৃত্বাধীন ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন’ এর সনদ গ্রহণ না করে আমদানি করা কোনো ওষুধ ভারতে বাজারজাতের সুযোগ নেই। ফলে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করে তা বাজারে ছাড়তে দেশটির আমদানিকারকদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় ওই সনদের জন্য। তাতে অনেক সময় ওষুধ যেমন নষ্ট হয়, তেমনি অনেক ওষুধের মেয়াদও ফুরিয়ে যায়। এ কারণে দেশটির আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে ওষুধ নিতে আগ্রহ হারাচ্ছে।
রপ্তানিপণ্য ছাড়করণে এ ধরনের নানা অসুবিধার পরও সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে। কারণ বাংলাদেশি পণ্যের মূল বাজার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় যেসব ব্যাংক বা ব্যাংকের শাখা রয়েছে, তাদের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন বা ঋণপত্র (এলসি) খোলার সামর্থ্য সামান্য। তা ছাড়া এসব ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সরাসরি অর্থ লেনদেন করতে পারে না।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গত সাত বছরের আমদানি-রপ্তানির ফারাকের তথ্য তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, সার্কের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্য শক্তিশালীকরণে দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়ভাবে কাজ করছে। তবুও কিছু অশুল্ক বাধা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা দুই দেশের বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে ভারত বিশাল দেশ, যার বিপুলসংখ্যক রপ্তানিযোগ্য পণ্য রয়েছে। সেসব পণ্যের অনেকটারই বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোয় চাহিদা ও সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বিদেশ থেকে যত পণ্য আনে তার মধ্যে চীনের পরই ভারতের অবস্থান। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বলার মতো নয়। দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি এবং দিন দিন তা বাড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়াতে হলে সব ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করে সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশি পণ্যকে সহজ প্রবেশাধিকার দিতে হবে ভারতকে। শুধু শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে না। অশুল্ক বাধা দূর না করলে ভারতের বিশাল সম্ভাবনাময় বাজারে বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ে কোনো অবস্থানেই যেতে পারবে না।”কালের কণ্ঠ




Discussion about this post