
এখন আর তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে না। রাগ হয় না, বিস্ময় জাগে না, স্তব্ধতার গান বাজে না অলক্ষ্যে। অদ্ভুত শান্তভাবে বরং নিয়তিকে মেনে নিতে শিখেছেন তিনি। একের পর এক দল ঘোষিত হবে, আর সেখানে অনুপস্থিত থাকবে তাঁর নাম- এটি ধরে নিয়েছেন যে স্বাভাবিক হিসেবে! বিসিবির হাই পারফরমেন্স স্পিন বোলিং প্রোগ্রামের জন্য ১০ স্পিনারের মধ্যে নিজের নাম না দেখে তাই একটুও চমকাননি আবদুর রাজ্জাক।
তাই বলে ভাববেন না, হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। নিয়তিকে আপাতত মেনে পারফরমেন্সের কালিতে সেই নিয়তি লেখার প্রতিজ্ঞা জোরালো হয়েছে বরং। বয়স ৩৩ ছুঁই ছুঁই, তাতে কী? উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, তো? জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন বিসর্জন দেননি রাজ্জাক। এত বঞ্চনাতেও ওই বিশ্বাসের স্তম্ভে ধরেনি ঘুণ।
‘বিশ্বকাপের স্কোয়াড থেকে বাদ পড়ি যখন, তখন খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু পরে নিজেকে বুঝিয়েছি, মানুষের জীবনে ভালো-খারাপ কত সময়ই তো আসে! আমার না হয় তেমন খারাপ সময় যাচ্ছে। আর বাদ পড়তে পড়তে এমন অবস্থা হয়েছে যে, এখন বাদ পড়লে অবাক হই না’- বিষণ্নতার করুণ সুরে ফোনের ওপার থেকে বলে যান রাজ্জাক। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি যিনি। পাওয়ার প্লে ও ডেথ ওভারে বাংলাদেশ অধিনায়কের আস্থার সমার্থক হয়ে ছিলেন যিনি। সেই বাঁহাতি স্পিনার এভাবে ব্রাত্য হয়ে পড়লেন হঠাৎ। এমনভাবেই যে, নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে গড়া দেশসেরা ১০ স্পিনারের মধ্যেও থাকে না তাঁর নাম। প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ যতই বলুন রাজ্জাক তাঁদের বিবেচনায় রয়েছেন, পথের শেষে যতিচিহ্ন পড়ে যাওয়ার ইঙ্গিতটা যে একরকম স্পষ্টই!
রাজ্জাক সেটি মানেন না। বরং ঘোষণার সুরে বলেন, ‘পারফর্ম করতে থাকলে অবশ্যই আমাকে একদিন না একদিন ডাকবেই।’ তা পারফর্ম কি খুব খারাপ করছেন এই বাঁহাতি স্পিনার? সর্বশেষ প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের হয়ে ১০ ম্যাচে ২১ উইকেট নেন ১৪.৮০ গড়ে। জাতীয় ক্রিকেট লিগে খুলনা বিভাগের হয়ে ৭ ম্যাচে ৪১ শিকারে গড় ছিল ২৮.৮০। সর্বোচ্চ উইকেটশিকারে তাঁর চেয়ে এক ধাপ মোটে এগিয়ে ইলিয়াস সানি। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের ওয়ানডে ফরম্যাট ভালো কাটেনি। তিন ম্যাচে ৫৯.৫০ গড়ে ২ উইকেট। তবে বিসিএলের দীর্ঘ পরিসরে আবার চেনা রূপে। প্রথম দুই ম্যাচে রাজ্জাক নেন ১৬ উইকেট। চলমান শেষ ম্যাচের প্রথম ইনিংসে আরো ২ উইকেট। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হওয়াটা তাঁর জন্য কেবলই আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষায়।
তবু এইচপি-র এলিট প্রোগ্রামে ডাক পড়ে না রাজ্জাকের। এমন অবস্থায় নিজেকে অনুপ্রাণিত করা কঠিন নিশ্চয়ই? শুকনো হাসিতে জবাব দেন তিনি, ‘নিজেকে অনুপ্রাণিত করি এখন একভাবেই- যেখানে খেলি, ভালো খেলতে হবে। খারাপ খেললে আমার ভালো লাগে না। নিজের ভালো লাগার জন্য তাই ভালো খেলতে হবে।’ কিন্তু সাপ-লুডুর ক্যারিয়ারে মই বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ যে সাপে কাটল তাঁকে, সেখান থেকে আবার শীর্ষে পৌঁছানো কি সম্ভব? ঝলসে ওঠে রাজ্জাকের কণ্ঠ, ‘আমার বয়স এমন কিছু হয়নি যে, জাতীয় দলে ফেরা অসম্ভব। অনায়াসে আরো পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারব। আর অবসর নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আশপাশের অনেকের কাছে এ সম্পর্কিত কথা শুনি। কিন্তু অন্যদের চিন্তা নিজের মাথায় আনব কেন? আমি তো অশিক্ষিত বা গণ্ডমূর্খ না। আমি খুব ভালো করে জানি, পারফর্ম করতে থাকলে জাতীয় দলে অবশ্যই ফিরতে পারব।’
সেই প্রত্যাবর্তনের পথ যে কাঁটা বিছানো, রাজ্জাকের সেটি ভালোই জানা। বিশেষত আগামী মাসে ৩৩ বছরে পা দেওয়া এই ক্রিকেটারের ফিটনেস বড় সমস্যা। কিন্তু এটিকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মানতে নারাজ তিনি, ”এই যে এনসিএল হলো কিংবা বিসিএল, সেখানে তো প্রতিদিন আমি ৩০-৪০ ওভার করে বোলিং করি। ফিটনেস না থাকলে এত ওভার কিভাবে বোলিং করি? হ্যাঁ, তারপরও যদি জাতীয় ক্রিকেট দলের সেটআপের কেউ আমাকে বলত, ‘রাজ্জাক তোমার ফিটনেসের এই জায়গায় সমস্যা আছে, এটি নিয়ে কাজ করো’- তাহলে আমি সেটি করতাম। অমনটাও তো কেউ আমাকে বলে না।” নির্বাচকরাও তাঁকে জানান না বাদ পড়ার কারণ। ‘নিজের অবস্থান জানি আমি পেপার পড়ে, টিভি দেখে’- বলতে বলতে কষ্টটা আর চাপা থাকে না রাজ্জাকের।
পরক্ষণেই অবশ্য আবেগ সামলে নেন চটপট। নিজের প্রত্যাবর্তনের পথটা এঁকে নিতে সমস্যা হয় না রাজ্জাকের, ‘২০০৪ সালে অভিষেকের পর ২০১৪ সালটাই আমার খারাপ গেছে। তাতেই আমাকে ছুড়ে ফেলা হয়! আমি বুঝে গেছি, আগের ৯ দিন ভালো খেলার কথা সবাই ভুলে যায় দশম দিনে খারাপ খেললে। এত বছর দেশকে সেবা করার পর এটি আমার প্রাপ্য কি না- এমন আবেগভরা কথা বলতে চাই না। কেননা এসবের কোনো মূল্য নেই। আমি পারফরমেন্স দিয়েই তাই আবার জায়গা করে নিতে চাই জাতীয় দলে।’
সেটি যদি সত্যি পারেন রাজ্জাক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২৭৪ শিকারের চেয়ে তা কম আনন্দ দেবে না এই বাঁহাতি স্পিনারকে। পারবেন তিনি?
সুত্রঃ দৈনিক কালের কন্ঠ
Discussion about this post