ডেস্ক রিপোর্ট: যেকোনে সময় গ্রেফতার হতে পারেন যুবলীগের আলোচিত নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট। গ্রেফতার এড়াতে বারবার অবস্থান বদলাচ্ছেন তিনি। ইতিমধ্যেই তার অবস্থান সনাক্ত করে ফেলেছে আইনশৃংখ্লা বাহিনী। তিনি যেখানে আত্মগোপন করছেন সেখান থেকেই তথ্য আসছে সংস্থাগুলোর কাছে। গ্রিন সিগন্যাল পেলেই যেকোনো মুহূর্তে তার অবস্থানস্থল ঘিরে ফেলা হবে। নিয়ে আসা হবে আইনশৃংখলাবাহিনীর কব্জায়।
আইনশৃংখ্লা বাহিনীর একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ক্যাসিনো গডফাদার ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গোয়েন্দাজালে আটকা পড়েছেন। তার অবস্থান ঘিরে নজরদারি প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দারা।
এদিকে সম্রাটের গ্রেফতারের বিষয়ে গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘দেখবেন, আপনারা শিগগিরই দেখবেন। আপনারা অনেক কিছু বলছেন, আমরা যেটা বলছি ‘সম্রাট’ হোক আর যেই হোক অপরাধ করলে তাকে আমরা আইনের আওতায় আনব। আমি এটা এখনও বলছি, সম্রাট বলে কথা নয়, যে কেউ আইনের আওতায় আসবে। আপনারা সময় হলেই দেখবেন।’
যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ঢাকার জুয়াড়িদের কাছে ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত। জুয়া খেলাই তার পেশা ও নেশা। প্রতিমাসে ঢাকার বাইরেও যান জুয়া খেলতে। বিশেষ করে টাকার বস্তা নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। সেখানে জুয়ার পাশাপাশি নারীসঙ্গও উপভোগ করেন।
সম্প্রতি রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন সম্রাটের ডান হাত হিসেবে পরিচিত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর ধরা পড়েন রাজধানীর টেন্ডার কিং আরেক যুবলীগ নেতা জিকে শামীম। এ দুজনই অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন সম্রাটকে। তারা গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো সাম্রাজ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। প্রকাশ্যে চলে আসে সুন্দর অবয়বের আড়ালে সম্রাটের কুৎসিত জগত। এতে করে বেকায়দায় পড়েন সম্রাট।
সম্রাটের ঘনিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জুয়া-ক্যাসিনোবিরোধী পুলিশ ও র্যাবের অভিযানের শুরুতে সম্রাট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। এ সময় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও তাকে কেউ স্পর্শ করবে না- এমন বিশ্বাস ছিল। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপে রাখতে অভিযানের শুরুর দিকে তিনি দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কাকরাইলে মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের কার্যালয়ে অবস্থান নেন। কিন্তু অভিযানের গতি ক্রমেই বাড়তে থাকায় তিনি ঘাবড়ে যান। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পর সম্রাট গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেন।
যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, খালেদ ও জি কে শামীম গ্রেফতারের পর নড়ে বসেন সম্রাট। গ্রেফতার এড়াতে নানা মহলে লবিং শুরু করেন। যুবলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝাতে চান যে, তাকে ছাড়া ঢাকায় যুবলীগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মতো কেউ নেই। এভাবে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই এসব করেন সম্রাট।
যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা জানান, সম্রাট কিছুটা চাপে আছেন। তাকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হবে কিনা, বিষয়টি এখনও তিনি নিশ্চিত নন। তবে তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে চাপ বাড়ছে। এ কারণে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন তিনি।
মাদকবিরোধী সরকারের কঠোর মনোভাবে অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। শুরুতেই ঘন ঘন অবস্থানও পরিবর্তন করেন। যুবলীগের কার্যালয় থেকে ‘ছদ্মবেশ’ নিয়ে বেরিয়ে আসেন। এরপর দুটি ঠিকানা বদলের পর তিনি নির্ভরযোগ্য স্থানে চলে আসেন। বর্তমানে তিনি এখানেই পালিয়ে আছেন। কারও কারও মতে, সম্রাট কাকরাইলের অফিস থেকে বের হয়ে ঢাকার বাইরে চলে গেছেন।
এবং সীমান্তবর্তী কোনো এক জেলা থেকে তিনি দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। তবে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলোর দাবি, সম্রাট ঢাকায়ই অবস্থান করছেন। তাদের নজরদারিতেই আছেন তিনি।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, প্রভাবশালী বন্ধুরা কেউ তার ফোন না ধরায় সম্রাট বেকায়দায় পড়েছেন। অভিযান শুরুর পর থেকে দু-একজন ছাড়া অধিকাংশ প্রভাবশালী তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন। তার ফোনও ধরেন না। কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগও পাচ্ছিলেন না। এরপরও তিনি অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বর্তমান আস্তানায় চলে আসেন। সেখানে পৌঁছার পর ওই নেতা খুশি না হলেও তাকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন বলে জানায় সম্রাটের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৮ সেপ্টেম্বর রাত থেকে সম্রাটের ওপর নজরদারি শুরু করে। তবে যুবলীগ অফিস থেকে বের হওয়ার পর প্রথমদিকে তার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি থাকলেও গত কয়েকদিন একাই ঠিকানা বদল করেছেন।
প্রভাবশালী নেতার বাসায় তিনি একাই গেছেন। ঘনিষ্ঠ কাউকে কিছুই জানতে দেননি। কিন্তু এতকিছুর পরও তিনি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি। বিশেষ করে তিন-চার দিন ধরে সম্রাটের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে একাধিক সংস্থার কাছে। তিনি যাতে পালাতে না পারেন সেজন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি আরও জোরদার হয়েছে। সব মিলে অবস্থা এমন যে- তাকে গ্রেফতার করা এখন সময়ের ব্যাপার।
গ্রেফতারে বিলম্বের কারণেই সম্রাট বারবার অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ পাচ্ছেন। তার ঠিকানা বদলের বিষয়টিও গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেই হচ্ছে বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি দেখে সম্রাটও মোটামুটি নিশ্চিত যে, তিনি গ্রেফতার হবেন। কাজেই যে কোনোভাবে গ্রেফতার এড়াতে সব ধরনের চেষ্টা করেছেন তিনি। তদবির করছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার কাছে। কিন্তু এ সময়ে কেউ তার পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছেন না। অধিকাংশই এড়িয়ে চলছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অভিযানের বিষয়ে রয়েছেন কঠোর অবস্থানে থাকায় তার ফোনও ধরছেন না কেউ।
এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমের সামনে মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনের এ অভিযান নিয়ে জিরো টলারেন্সের কথা বলছেন। এজন্য সম্রাটের পক্ষে কেউ তদবির করার ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছেন না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্রাট পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন। তিনি ঢাকাতেই আছেন। সম্রাটের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সবাই সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন।
র্যাবের অভিযানে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতেই যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতার হন। ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন জি কে শামীম। এদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে আসে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটই ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো পরিচালনার মূল ব্যক্তি। তার হাত ধরেই ঢাকায় ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের বিস্তারিত ঘটে। সহযোগীদের মাধ্যমে তিনি ক্যাসিনো সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য তিনি ঘনিষ্ঠদের দায়িত্ব দেন। তারা আস্থার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নিয়মিত অর্থ তুলে দিতেন সম্রাটের হাতে। এ অর্থের বড় একটি অংশ ভাগ হয়ে বিভিন্ন হাতে চলে গেছে। বাকি অংশ গেছে নিজের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে। এছাড়া টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে জিজ্ঞাসাবাদে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরেরপুল ইয়াংমেনস ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ইয়াংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্রাটের শিষ্য খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন।
সম্রাটের ক্যাসিনোর দেখাশোনা করতেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তারা এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম–জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেছিলেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর মমিনুল সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান।
Discussion about this post