
প্রায় দুই বছর হতে চললেও ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন’-এর সংশোধনী প্রস্তাব উঠেনি মন্ত্রিসভায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ‘সংগঠনের’ বিচার করার জন্য চতুর্থ দফা এ আইন সংশোধনের কথা রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা মুক্তিযুদ্ধকালে সংগঠনগুলোর ভূমিকা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ। এরই মধ্যে দলটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বিচার সম্পন্ন হয়েছে, আরও কয়েকজনের বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ-সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আইনটির সংশোধন প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এর আগে ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফা এই আইন সংশোধন হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধন হয় ২০০৯ সালে। এরপর দ্বিতীয়বার ২০১২ সালে অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিচারের জন্য এবং তৃতীয় দফায় ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ব্যবস্থা করতে এই আইন সংশোধন করা হয়েছিল।
আইন সংশোধন : নতুন যা থাকছে
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) ১৯৭৩-এর খসড়া সংশোধনে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দলকে নিষিদ্ধের ক্ষমতা থাকবে ট্রাইব্যুনালের।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সংগঠনের বিচারের জন্য সংশোধন প্রয়োজন এমন ধারাগুলোতে ‘ব্যক্তি’র সঙ্গে ‘অথবা সংগঠন’; ‘দায়’ শব্দের সঙ্গে ‘অথবা সাংগঠনিক দায়’; ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি ও সংগঠন’ সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে এই আইনের তিনবার সংশোধন আনা হয়। ওই সংশোধনগুলো ত্বরিত গতিতে হলেও সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত দলগুলোর বিচারের সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগটি দীর্ঘদিন ঝুলে আছে।
আবারও আশ্বাস দিলেন আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের তরফ থেকে একাধিকবার আইনটির সংশোধন ‘শিগগিরই’ মন্ত্রিসভায় উঠবে বলে আশ্বাস দেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সংগঠনের বিচারে আগামী বছরের (২০১৫) জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভায় একটি সংশোধিত আইনের খসড়া উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিলেই পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপের সঙ্গে বৈঠক শেষে (১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় আগামী সোমবারের (২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) মন্ত্রিসভা বৈঠকে না উঠলে এর পরের বৈঠকে (২ মার্চ) আইনের খসড়াটি উঠবে।’
দশম জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ (বাজেট) অধিবেশনে ২০১৫ সালের ১ জুন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে আইনের সংশোধন আনার কথা রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি বিল মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন দিলে (আইনটি) সংসদে আসবে।’
সর্বশেষ ৯ এপ্রিল জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আবারও বলেন, ‘হ্যাঁ, উঠবে’।
‘কিন্তু এর আগেও একাধিকবার এ সংশোধন আইন মন্ত্রিসভায় উঠবে বলে জানিয়েছিলেন’— এ কথার জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেছিলাম। এখনো বলছি, উঠবে, খুব শিগগিরই উঠবে।’
কিন্তু, এবার কোনো দিন-তারিখ উল্লেখ করেননি মন্ত্রী।
যেভাবে সংশোধন উদ্যোগ…
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন সংগঠন ও একাধিক ব্যক্তি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অপরাধীদের বিচারের সঙ্গে ওইসব অপরাধীরা যে সব সংগঠনের হয়ে অপরাধ করেছে সেইসব সংগঠনেরও বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল।
‘দরকার’ আইনের সংশোধন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক মোহাম্মদ আবদুল হান্নান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জামায়াত এবং এর অঙ্গ-সংগঠনগুলোর বিষয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত অনেক আগেই আমরা সম্পন্ন করেছি। এখন আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব প্রসিকিউশনের। এর জন্য আইনের সংশোধন দরকার, এটা দেখার দায়িত্ব সরকারের।’
তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে জামায়াতের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০১৪ সালের ২৭ মার্চ এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল। তদন্ত সংস্থা আবার সেটি ফেরত চাইলে একই বছরের ১৯ মে সেটি দিয়ে দিয়েছি। আইনের সংশোধন এখানে গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রণীত হওয়ার পরপরই এর আওতায় বিচারকাজ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয়বার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়। -দ্য রিপোর্ট




Discussion about this post