নিজস্ব প্রতিবেদক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে (ট্রুথ কমিশন) অনুকম্পা পাওয়া আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির অনুসন্ধান পুনরায় শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। অনুকম্পা সনদ নেওয়ার আগে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা ৯০টি মামলাও সচল করা হচ্ছে। ২৬৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৪৪৮ জন ট্রুথ কমিশন থেকে অনুকম্পা সনদ নিয়েছিলেন।
আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজরা আবারও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন কিনা, তা যাচাই করে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদক মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। এতে দুর্নীতির তথ্য মিললে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
ট্রুথ কমিশন থেকে অনুকম্পা পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্যদের দুর্নীতির অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলার বিষয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর একটি অফিস আদেশ জারি করে দুদক।
দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিনের সই করা ওই অফিস আদেশে বলা হয়েছে- দুর্নীতিবাজদের অনুকম্পার জন্য ‘স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ অধ্যাদেশ-২০০৮’ জারি করে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। অনেকেই অনুকম্পা নিয়েছেন। কিন্তু ওই অনুকম্পা বৈধ নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। ফলে যারা অনুকম্পা নিয়েছিলেন তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’
অফিস আদেশটি দুদকের প্রধান কার্যালয়সহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মাত্র পাঁচ মাস কার্যক্রম চালানোর পর বিলুপ্ত হওয়া ট্রুথ কমিশনের কার্যক্রম উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করলেও প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে কোনও অসুবিধা নেই। তাই অনুসন্ধান-তদন্তের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে এগোচ্ছে দুদক।
ট্রুথ কমিশন থেকে যারা অনুকম্পা নিয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগই ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ- ডেসা, নিবন্ধন পরিদফতর, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ-ওয়াসা, টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ বোর্ড- টিঅ্যান্ডটি, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর- এলজিইডি, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা, ডাক বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএ, তিতাস গ্যাস, বন বিভাগ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক, গৃহায়ন অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি- বিটিসিএল, সাব-রেজিস্ট্রার এবং ঢাকা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী।
২০০৮ সালের ৮ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনফরমেশন অর্ডিন্যান্স বা স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ অধ্যাদেশ-২০০৮’ জারি করে করে মাত্র পাঁচ মাসের জন্য ‘সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন- ট্রুথ কমিশন’ গঠন করে। দোষ স্বীকার করলে লঘু দণ্ড দিয়ে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য গঠিত ট্রুথ কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয় ওই বছরের ৩ আগস্ট। কমিশনের কার্যকাল ছিল ২০০৯ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত।
ওই পাঁচ মাসে ৪৯১ জন দুর্নীতিবাজ অনুকম্পা চেয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে শুনানিতে অংশ নিয়ে আর্থিক দণ্ড দেয় ৪৪৮ জন। তাদেরই অনুকম্পার সনদ দেয় ট্রুথ কমিশন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয় প্রায় ৩৪ কোটি টাকা। অনুকম্পা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি আছেন ২৬৫ জন। এছাড়া ২৮ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্ত্রীরাও অনুকম্পা সনদ নিয়েছেন।
২০০৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়া টাকার চেকসহ প্রতিবেদন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছে জমা দেন বিলুপ্ত হওয়া ট্রুথ কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান।
‘স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ অধ্যাদেশ-২০০৮’ ও ট্রুথ কমিশন গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট আইনজীবী আদিলুর রহমান খান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আক্তার, আওয়ামী লীগ নেত্রী দীপু মনি এবং মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানসহ পাঁচজন যৌথভাবে হাইকোর্টে রিট করেন। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ট্রুথ কমিশন এবং স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ অধ্যাদেশ-২০০৮ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে লিভ টু আপিল দায়েরের নির্দেশ দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল করেনি। ২০১১ সালের ১৬ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বহাল রাখেন।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে বলা হয়, ‘সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন বা ট্রুথ কমিশন সংবিধান পরিপন্থী। একই অপরাধে কারও প্রচলিত আইনে শাস্তি হবে, আবার কাউকে বিশেষ ব্যবস্থায় অনুকম্পা করা হবে- এমনটা আইনসম্মত নয়।’
এই রায়ের ফলে ট্রুথ কমিশনে দায়মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা নেওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। তবে রায় ঘোষণার দীর্ঘদিন পর অফিস আদেশের মধ্য দিয়ে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে দুদক।




Discussion about this post