বিডি ল নিউজঃ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে কেউই কোন দিন নিজেকে বীর বানাতে পারে নি, তার অধঃপতন নিশ্চিত। কোরবানির ঈদের ঠিক ২/১ দিন আগে হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও প্রাথমিক সদস্যপদ হারানো আবদুল লতিফ সিদ্দিকী শোকজ (কারণ দর্শানো) নোটিশের জবাবে কৃতকর্মের জন্য দলের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে সাময়িক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আবেদনও জানান।
গত ১৪ অক্টোবর প্রাথমিক সদস্যপদ কেন স্থায়ীভাবে বাতিল করা হবে না, এ ব্যাপারে দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছিল লতিফের কাছে। গত ২২ অক্টোবর তিনি এ নোটিশের জবাব দেন। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় ২৪ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় লতিফ সিদ্দিকীর প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লতিফের শোকজ নোটিশের জবাবের একটি কপি দ্য রিপোর্টের কাছে এসেছে।
লতিফ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘আমি আমার কৃতকর্মের জন্যে সংগঠন, সংগঠনের কর্মী, সমর্থক এবং দলনেতার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রাথমিক সদস্য থেকে আমার সাময়িক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানাচ্ছি।’
কারণ দর্শানোর নোটিশের উদ্ধৃতি দিয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে উদ্দেশ করে লতিফ লিখেছেন, “এতগুলো শব্দচয়ন করলেন, একটি শব্দ যে অনুপস্থিত তা ঠিক আপনার মনেই আসেনি- বহুলচর্চিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘যুগদাবী’, ‘বাক-স্বাধীনতা’, ‘মত প্রকাশের অধিকার’, ‘মুক্তচিন্তা’, ‘মানবতা’, ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ তবে কি বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত?
সরল, সহজ শিক্ষাপ্রদ আলাপচারিতার খণ্ডরূপ বিকৃতভাবে প্রকাশিত হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমার সরল-সহজ-শিক্ষাপ্রদ আলাপচারিতার খণ্ডরূপ বিকৃতভাবে প্রকাশিত হওয়ায় আমার দল ও দলনেতা যে আমার প্রতি রুষ্ট, বিরক্ত; তা ১২ অক্টোবরের প্রস্তাবের ভাব-ভাষা-বাক্য গঠনেই অনুমেয়। প্রেসিডিয়াম সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য- এ পদগুলো আলঙ্কারিক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য আমার হৃদস্পন্দন। এটা কেড়ে নিলে প্রাণহীন দেহ ধারণের আর প্রয়োজন রইল কি! আমি না হয় অবিবেচক, অপরিনামদর্শী-সমষ্টি এবং নেতা (দলীয় সভানেত্রী) অবশ্যই বিবেচক। সমষ্টি ও নেতার নিকট আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মানবীয় দুর্বলতা প্রত্যাশী।’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি হোটেলে নিউইয়র্ক টাঙ্গাইল সমিতির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে লতিফ হজ, হযরত মুহম্মদ (সা.), তবলিগ জামাত ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এর পরই দেশজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। এর পর তিনি আর দেশে ফেরননি। লতিফ সিদ্দিকী এখন কলকাতায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এক হাজার শব্দের চিঠিতে লতিফ সিদ্দিকী নিজের গুণগানের সঙ্গে, তার দর্শন তুলে ধরেছেন বিস্তৃতভাবে। তিনি লিখেছেন, “আসলে আমি মনে-প্রানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘দলকানা’ কর্মী, বঙ্গবন্ধু-নির্দেশিত ‘সোনার বাংলা’র রূপচ্ছবি, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন আর আমার রাজনৈতিক নেতা ও নির্দেশক শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০২১-এর নিবেদিত প্রাণসত্ত্বা। একই সঙ্গে আমি এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্ত্বা, নিজস্ব মনন কর্ষণ ও চর্চার ভুবনও আমার আছে।”
‘দীর্ঘদিনে আমার স্বতন্ত্র সত্ত্বা ও মনন কর্ষণ-চর্চার সঙ্গে সংগঠন কর্মকাণ্ডে ছোটখাটো ঠোকাঠুকি হলেও বর্তমানের মত মুখ ব্যদান-করা কোনো ঘটনার উদ্ভব হয়নি। ফলে ব্যক্তি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বড়, না কি ব্যষ্টি যে-সামষ্টিক সত্ত্বায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে, সেই সামষ্টিক সত্তারূপে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অগ্রগণ্য, সে প্রশ্ন সামনে এসে পড়ছে। কোনো যুক্তি-তর্কে না গিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীনভাবে সকল ক্ষেত্রে প্রবল-প্রত্যয়ে যেমন নিজেকে উচ্চারণ করি, এ ক্ষেত্রেও তীব্র, তীক্ষ্ম, তীর্যকভাবে স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সবকিছুর ঊর্ধ্বে।’
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব হারানো লতিফ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘সামষ্টিক মানুষের সমর্থনে সৃষ্ট যে ভাবমূর্তি এবং নেতার প্রদেয় যে পদ আর পদমর্যাদা, নেতা তা ফিরিয়ে নিক, কেড়ে নিক। ব্যক্তি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তাতে যদি অসন্তুষ্ট বা অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত বলে মত প্রকাশ করে, তবে কি তার দীর্ঘ পথচলার ব্যক্তিক যে সামান্য অর্জন, সাজেদাপার ‘মুখফোড়’ এই মধুর ও মর্যাদাপূর্ণ অভিধাটি আর থাকে?’
‘গঠনতন্ত্রের কোন ধারায় কি আছে তা আমরা সবাই জানি, তার চেয়েও বড় কথা আমার সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদ সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক, নেতা তার প্রাণভোমরা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে, দুয়ে মিলে তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা হৃষ্টচিত্তে মেনে না নেওয়ার মতো ব্যক্তিস্বার্থে লতিফ সিদ্দিকী এত উন্মাদ হয়ে যায়নি।’
“আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর চেতনা এখনও শাণিত, দেহ এখনও ঋজু, মন এখনও সতেজ। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মনে করে মানুষ ‘আমৃতস্যঃ সন্তান’, তাই কীটস যখন বলেন, ‘ট্রুথ ইজ বিউটি, বিউটি ইজ ট্রুথ’ তখন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আপ্লুত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর মেটাফিজিক্যাল স্কুল অব পোয়েট্রির কবি জন ডন যখন বলেন, ডেথ বি নট প্রাউড, ফর ডেথ স্যাল ডাই (ওহে মৃত্যু তুমি মোরে না দেখাও ভয়, ও ভয়ে কম্পিত নহে আমার হৃদয়)’ এবং ‘হোল্ড ইয়োর টাং অ্যান্ড লেটমি লাভ (চুপ কর, ভালোবাসবার দে মোরে অবসর), তখনও প্রাণিত না হয়ে পারে না।”
সমাজতন্ত্রী কিংবা মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রী নন জানিয়ে টাঙ্গাইলের এই আলোচিত সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমি সমাজতন্ত্রী, মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রী নই। মুজিবীয় ধারাকে বিকশিত করতে মাকর্সের বহু মতামত, অভিমত, ভাবনা, চিন্তা, যুক্তি ও সমাজ-বিশ্লেষণ গ্রহণ করি, তারপরও আমার সকল কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি মুজিবীয়।’
নোটিশের জবাব হল কিনা এ নিয়ে নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা লতিফ সিদ্দিকী। তিনি জবাবে লিখেছেন, ‘কোন জবাব হল কিনা তা বলতে পারব না, তবু এও আমার একটি অবস্থার প্রকাশ। সমগ্র আমির স্বরূপ প্রকাশিত হলে আরও সংশয় সৃষ্টি করবে। আমার কোনো অহঙ্কার নেই, দম্ভকে গলা টিপে রাখি, হিংষা-দ্বেষ ঘৃণা আমার জীবনবেদে ঠাঁই পায়নি। যাকে এ সবের প্রমাণরূপে অনেক সময় উল্লেখ করা হয় তা ব্যক্তিত্বের দৃঢ় প্রত্যয়, অবিচল নিষ্ঠা মাত্র। আমি বিশ্বাস করি, মুহূর্তের পিচ্চিলতা কিংবা কক্ষচ্যুতি মানবতার স্থায়ী অঙ্গীকারকে ম্লান করতে পারে না, সৃষ্টি ও সেবার প্রতি নিষ্ঠাই আমার ধর্ম।’
সূত্রঃ দ্য রিপোর্ট
Discussion about this post