পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রথমবারের মতো দরবার (কল্যাণ প্যারেড) করেছে পুলিশ। দরবারকালে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একগুচ্ছ দাবি উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৩ সালে প্রণীত নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবিটি ছিল প্রধান। এই দাবি উত্থাপন করে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ আইনে ইতোমধ্যে বেশকিছু পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। এ আইনের কারণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলার আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে একরকম ভীতির মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। ফলে মামলা-সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই বের করা সম্ভব হয় না। এতে জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাহত হয়ে থাকে।
এবারই প্রথম পুলিশের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দরবার (কল্যাণ প্যারেড) করল। এর আগে কখনো এ ধরনের দরবার হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব দাবি উত্থাপন করা হয় তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নোট রাখতে প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। আইনটি বাতিলের দাবি তুলে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধিসহ বিদ্যমান অন্য আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দায়িত্ব পালনে ‘সেফ গার্ড’ প্রদান করেছে। আর নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে পুলিশের অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। যে কারণে আইনটি বাতিলে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কল্যাণ প্যারেডকালে কুমিল্লা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন বলেন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার বিধান রেখে একটি বেসরকারি বিলের মাধ্যমে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন করা হয়েছে। এই আইনে নির্যাতনের সংজ্ঞায় মানসিক কষ্টকে নির্যাতন বলা হলেও তা নির্ধারণের কোনো মানদ- নেই। ফলে যে কেউ এই আইনে পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার সুযোগ পাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে যে কোনো নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত ব্যতিরেকে আবশ্যিকভাবে এ আইনের অধীনে তদন্ত কর্মকর্তা, অফিসার ইনচার্জ বা কমান্ডিং অফিসারের বিরুদ্ধে ‘সুয়োমোটো’ মামলা নেওয়ার জন্য জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কল্যাণ প্যারেডে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নানা দাবির মধ্যে এক নারী কনস্টেবল বলেন, বর্তমানে তাদের বছরে ২ সেট ড্রেস প্রদান করা হয়। তাদের বছরে ৩ সেট ড্রেস প্রদানের দাবি করা হয়। পুলিশের এক সার্জেন্ট এবং ইন্সপেক্টর পুলিশের আবাসন সংকট দূর করার দাবি তোলেন। অন্যদিকে একজন এএসপি বলেন, বিভিন্ন জেলায় পুলিশ লাইনসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণে জমি পাচ্ছে না পুলিশ। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী পুলিশ কনস্টেবলদের বছরে ৩ সেট ড্রেস প্রদানের নির্দেশ দেন।
কল্যাণ প্যারেডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, পুলিশ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করছে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করছে। সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে গিয়ে তারা হতচকিত হয়নি। জনগণও জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, প্রথমবারের মতো পুলিশের সব পর্যায়ের সদস্যদের নিয়ে কল্যাণ প্যারেড হলো। এটা পুলিশবাহিনীর ইতিহাসে অত্যন্ত স্মরণীয় দিন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে পুলিশের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আইজিপি বলেন, জনবল বাড়ানো ছাড়াও বিভিন্ন বিশেষ ইউনিট গঠন করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। পুলিশের জন্য বাজেট বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ সরকারের অনুগত শৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিল হিসেবে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) বিল উত্থাপন করেন। ২০১৩ সালে বিলটি জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হয়। সাবের হোসেন চৌধুরী একসময় পুলিশ দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা দিতেই দফায় দফায় যাচাই-বাছাই শেষে এই আইনটি জাতীয় সংসদ পাস করেছিল। আইনটিতে মোট ২০টি ধারা রয়েছে। যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়াও সব ধরনের সরকারি হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়ার নানা বর্ণনা দেওয়া আছে। আইন প্রণয়নের দুই বছর পর ২০১৫ সালে পুলিশের পক্ষ থেকে ওই আইনের ১৪টি ধারা ও উপধারা সংশোধনী চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। প্রস্তাবে আইনের ৭টি ধারা বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়। পাশাপাশি একটি নতুন ধারা সংযুক্তি করার সুপারিশ করা হয়। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম দরবারকালে পুরো আইনটিই (নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) বাতিলের আবেদন করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
দুই বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পুলিশের ওই প্রস্তাবটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ৪ মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশের প্রস্তাব এবং এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের মতামতসহ পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়ে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
পুলিশের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু প্রণীত আইন বিচারব্যবস্থা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় ধারা সংযোজিত হয়েছে। এ ছাড়া আইনে মামলা দায়ের, তদন্ত কার্যক্রম, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শাস্তি অনুযায়ী জামিনপ্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বিধানও যুক্ত করা হয়েছে।
এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।




Discussion about this post