নিজস্ব প্রতিবেদক: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট নিয়োগে গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ নিয়োগের আগে বিমানের সর্বোচ্চ স্তর পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি।
প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়স নির্ধারণে প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ না করে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা দিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করা হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম মোসাদ্দিক আহমেদের ভাতিজাসহ কমপক্ষে ৩০-৩২ জন প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
ভাতিজাকে নিয়োগ দিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এম মোসাদ্দিক আহমেদ নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এমডি ডেলিগেশন অব পাওয়ারের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছেন। শুধু তাই নয়, পছন্দের প্রার্থী ও একটি গ্রুপকে অবৈধ সুবিধা দিতে বাছাই কমিটির আহ্বায়ককে না জানিয়ে পুরো নিয়োগের বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।
অপারেশন ম্যানুয়েল পার্ট ‘এ’ অনুযায়ী নিয়োগের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়নি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা মানবণ্টন অনুযায়ী না করে মৌখিক পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ নম্বর রেখে বিশেষ প্রার্থীদের সুবিধা দেয়া হয়েছে।
এদিকে সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে এবার দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আরও কঠোরভাবে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। সরকারি কোনো দফতরে দুর্নীতি জনহয়রানি কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না মর্মে প্রধানমন্ত্রী সুদৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেন। সরকার গঠনের পরপরই সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
যে কারণে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও দফতরে যাতে দুর্নীতি হতে না পারে সে জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিশেষ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেয়া হযেছে। এর অংশ হিসেবে বিমান মন্ত্রণালয়েও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান জোরদার করা হয়েছে। দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন যারা দুনীতি করবে তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। ক্যাডেট পাইলট নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে একটি অভিযোগ করা হয়।
এ নিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরে ‘বিমানের পাইলট নিয়োগে ধাপে ধাপে দুর্নীতি’ ও ২২ মার্চ ‘বিমানের দুর্নীতিবাজদের আমলনামা সচল’ শিরোনামে দুটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই সূত্র ধরে বিষয়টি তদন্তে পাঠান মন্ত্রণালয়ের সচিব। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জনেন্দ্র নাথ সরকারকে। তিনি তদন্ত শেষ করে গত ২ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে পাইলট নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াকে মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ চিহ্নিত করে নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করেন।
একই সঙ্গে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি সৃষ্টির জন্য নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করেন। বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদে পাঠিয়ে এ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলেও জানানো হয়। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত রিপোর্টটি ইতিমধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামতও নেয়া হয়েছে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পাইলট নিয়োগে জড়িত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা যুগান্তরকে নিশ্চিত করে বলেন, পাইলট নিয়োগের এই গুরুতর অনিয়মসহ বিমানের বড় বড় সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বিমান সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এ অবস্থায় তদন্ত প্রতিবেদনসহ নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করে বিমানের আগামী পরিচালনা পর্ষদ সভায় বিষয়টি উত্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ওই সভায় বাতিলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এতে ফেঁসে যাবেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এম মোসাদ্দিক আহমেদ।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পর্ষদ সভায় এ নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বাতিল করা না হলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বেন পর্ষদ সদস্যরা। কারণ ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে এই নিয়োগে এমডি ছাড়াও পরিচালনা পর্ষদের বেশ কয়েকজন সদস্যের প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এ বছর পাইলট নিয়োগে মোট ১৩ ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বিমান এমডি ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দিক আহমেদের ভাতিজা মোক্তাদির আহম্মদকে সুযোগ দিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তাতে সংশোধনী এনে শিক্ষাগত যোগ্যতা হ্রাস করা। শিথিল বিজ্ঞপ্তির সুযোগে এমডির ভাতিজাসহ প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে বাতিল হওয়া ৩০ জনের আবেদন বৈধ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে ১৩ জন চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হকের বক্তব্য নিতে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বিমান এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ এর আগে নিজের ভাতিজার পক্ষে নিয়োগ প্রসঙ্গে শক্ত অবস্থান নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার পর এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তাধীন একটি বিষয়ে তিনি এখন আর কথা বলতে চাচ্ছেন না। যদিও আগে বলেছেন, এই নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। তার ভাতিজা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় যথাযথভাবে পাস করেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে তাকেসহ ৩২ জনকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।
বিমান পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিষয়টি পর্ষদে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কোম্পানির শূন্যপদে জনবল নিয়োগের আগে অনুমোদিত পদ, শূন্যপদ ও অর্থের সংস্থান বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে নিয়োগের অনুমোদন নিতে হয়। পর্ষদ কোম্পানির কার্যক্রম, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে জনবল নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করে থাকে। কিন্তু এমডি পরিচালনা পর্ষদকে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি। পর্ষদকে অন্ধকারে রেখে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানের অপারেশনাল ম্যানুয়েল অনুসারে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য নম্বর বণ্টন সুনির্দিষ্ট থাকলেও সিলেকশন কমিটি কেন এটি অনুসরণ করে সমন্বিত মেধা তালিকা তৈরি করেনি, তা বোধগম্য হয়নি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিলেকশন কমিটি এ নিয়ে কোনো যৌক্তিক ব্যখ্যাও দিতে পারেননি। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, সিলেকশন কমিটি কাউকে বা কোনো গ্রুপকে সহযোগিতা করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য সিলেকশন কমিটি ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার নম্বরকে ৭৫ শতাংশ এবং মৌখিক পরীক্ষার গৃহীত নম্বরকে ২৫ শতাংশ ধরে একটি তালিকা তৈরি করেছে। যে ৫৪ জন পাস করেছে তাদের ফলাফল পুনরায় প্রস্তুত করে দেখা গেছে কমপক্ষে ৫ জন প্রার্থীর ফলাফল পরিবর্তন করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ৩২ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল সে তালিকা থেকে ৫ জন বাদ যায় এবং ৩৩-৩৭ তালিকায় থাকা প্রার্থীরা উপরে উঠে আসে। সমন্বিত তালিকা প্রস্তুতকালে ম্যানুয়েলে বর্ণিত বিধান অনুসরণ না করে কমপক্ষে ৫ জন প্রার্থীর প্রতি অবিচার করা হয়েছে।
৭৬ জন প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ ফলাফল বিবেচনা করা হলে অবিচারের তালিকা আরও দীর্ঘ হতো। নিয়োগের ক্ষেত্রে ৭৫ নম্বরের লিখিত এবং ২৫ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার বিধান থাকলেও এই নিয়োগে তা মানা হয়নি। সংগঠনটির ওঅ্যান্ডএম এবং অপারেশনাল ম্যানুয়েল অনুসারে ক্যাডেট পাইলট পদের জন্য বয়স ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক যুক্তিহীনভাবে এ বয়স ৪০ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের অনুমতি দেয়।
প্রথম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এমডির ভাতিজাসহ ৩০ জন প্রার্থী আবেদনই করতে পারতেন না। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করে তাদের আবেদন করার সুযোগ করে দেয়া হয়। প্রার্থীদের আবেদন চার সদস্যের কমিটির মাধ্যমে বাছাই করার কথা থাকলেও করা হয়েছে তিন সদস্যের কমিটির মাধ্যমে। কমিটির আহ্বায়ককে বিষয়টি জানানোই হয়নি। মৌখিক পরীক্ষার সময় কমিটির সদস্য চিফ অব ট্রেনিং উপস্থিত ছিলেন না। ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিংকে দিয়ে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। চিফ অব ট্রেনিং এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
বিমানের বি-৭৩৭ এবং ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ চালানোর জন্য ৩১টি শূন্যপদে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় বিমান ব্যবস্থাপনা কমিটি। গত বছরের ১৮ আগস্ট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এইচএসসি বা সমমানের ডিগ্রিতে ন্যূনতম জিপিএ ৩। পদার্থ ও গণিতেও একই জিপিএ। ও-এ লেভেলে ন্যূনতম গ্রেড বি। ‘এ’ লেভেলে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে গ্রেড ‘বি’ থাকতে হবে। জিইডি সনদধারীরা আবেদন করতে পারবেন না। বয়স নির্ধারণ করা হয় ১৮ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর। প্রতি ২০০ ঘণ্টা ফ্লাইংয়ের অভিজ্ঞতার জন্য এক বছর করে প্রার্থীদের বয়স শিথিল করা হয়। এভাবে সর্বোচ্চ বয়স ৪০ বছর নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু হঠাৎ করে ১৮ অক্টোবর সংশোধিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে পদার্থ ও গণিতসহ এইচএসসি (বিজ্ঞান) অথবা সমমানের ডিগ্রিতে ন্যূনতম গ্রেড ‘বি’ বা জিপিএ-৩ চাওয়া হয়। ‘এ’ লেভেলে জিসিএসই চাওয়া হয় ২ দশমিক ৪। কোনো পর্যায়েই তৃতীয় বিভাগ গ্রহণ না করার কথা বলা হয় সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ভাতিজা মোক্তাদির আহম্মেদের বয়স ছিল ২১ বছর ৭ মাস ৪ দিন। তবে এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘এ’ লেভেল, গ্রেড নেই। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে গ্রেড ‘সি’। প্রথম দফায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন অনুযায়ী তিনি নিজে এবং ৩০ জনের একটি গ্রুপের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। তাদের যোগ্যতা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত যোগ্যতার চেয়ে কম।
এতে টনক নড়ে এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদের। তড়িঘড়ি করে তিনি নিজের ঘনিষ্ঠ ও বিমান প্রশাসন বিভাগের সবচেয়ে বিতর্কিত অফিসার মোহাম্মদ বারীকে দিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করান। প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে গ্রেড বি/জিপিএ-৩ উল্লেখ ছিল।
সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে পদার্থ ও গণিতের জন্য কোনো গ্রেড না থাকায় এবং জিসিএসইতে ২ দশমিক ৪ অন্তর্ভুক্ত করায় প্রার্থী মোক্তাদির আহম্মেদসহ অপর ৩০ জনের আবেদন বৈধ হয়ে যায়। এর পুরস্কার হিসেবে বারী নামের ওই অফিসারকে পার্সোনাল শাখায় পদায়ন করা হয়। বারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও মোসাদ্দিক আহম্মেদ এ নিয়ে কোনো তদন্ত করেনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পাইলট নিয়োগের অন্যতম অনিয়ম ছিল ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা এবং ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা। মৌখিক পরীক্ষায় পাস নম্বর ছিল ৫০। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মৌখিক পরীক্ষার এই ১০০ নম্বরই পছন্দের সব প্রার্থীকে পাস/ফেল করানোর অন্যতম নিয়ামক ছিল। যার মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষায় পাস করা ৭৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ২২ জনকে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো হয়েছে।
অপরদিকে লিখিত পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েও পছন্দের অনেক প্রার্থীই মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেছে। তারা বলেছেন, কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার নজির নেই। নিরপেক্ষতার স্বার্থে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর লিখিত পরীক্ষার নম্বরের চেয়ে কখনও ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি হয় না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অবৈধ সুবিধা দিয়ে যে ৩২ জনকে আবেদনের যোগ্য করা হয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে ১৯ জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ১৩ জন লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সম্মিলিত ফলাফলে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়। এতে প্রতীয়মান হয়, একটি পক্ষকে সুবিধা দিতে পরিচালনা পর্যদের অগোচরে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হযেছে, বিমানের মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পাইলটদের সংগঠন বাপার চাহিদামতো পাইলট নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালিত হয়েছে, যা নজিরবিহীন। অভিযোগ আছে বাপার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাকসুদ আহম্মেদের ছেলেই হচ্ছেন বিমান এমডির ভাতিজা। এছাড়া বাপার কার্যকরী পরিষদের একজন সদস্যের স্ত্রীও পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। যিনি একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সে কর্মরত ছিলেন।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগের ২০০৯, ২০১০ ও ২০১৬ সালে যেসব নিয়োগ হয়েছে তার একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। সংস্থাটির সব নিয়োগই প্রশ্নবিদ্ধ। বিভিন্ন নিয়োগে সুবিধাজনক ব্যাখ্যা দিয়ে নিয়োগের যোগ্যতা ও বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। বিমানের মতো সরকারি একটি পুরনো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের জনবল নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ম্যানুয়েল বা রেগুলেশন নেই।
তারা ওঅ্যান্ডএম, অপারেশনাল ম্যানুয়েল এবং সার্ভিস রেগুলেশন অনুসরণ করেন। কিন্তু কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই। তাই এগুলো সমন্বিত করে রেগুলেটরি সংস্থা হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করা জরুরি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিমানের বিভিন্ন ম্যানুয়েল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানোর কোনো বিধান নেই।
অথচ আলোচিত এ নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় ৫ জন প্রার্থী ৭০-এর বেশি নম্বর পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেছেন। ১৪ জন প্রার্থী ৬০-এর বেশি নম্বর পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই লিখিত পরীক্ষায় ভালো করলেও মৌখিক পরীক্ষায় সব সময় ভালো করতে পারেন না। কিন্তু ৭৬ জনের মধ্যে ২২ জন লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার পরও ফেল করার ঘটনা স্বাভাবিক নয়।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ১৪৯টি আবেদন জমা হয়। বাছাইয়ের পর ১২০টি আবেদন বৈধ হয়। বিমানবাহিনীর মাধ্যমে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর এমসিকিউ এবং বর্ণনামূলক পরীক্ষা হয়। এমসিকিউর পাস নম্বর ছিল ৬০ শতাংশ এবং বর্ণনামূলকে ৫০ শতাংশ।
৭৬ জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। বিমানের চিফ মেডিকেল অফিসার প্রার্থীদের সাইকোমেট্রিক টেস্ট গ্রহণ করেন। বিমান নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ৭৬ জনের মৌখিক পরীক্ষা ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি নেয়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর একত্রিত করে ফল প্রস্তুত করা হয়। এতে মোট ৫৪ জন উত্তীর্ণ হয়। এদের মধ্যে ৩২ জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়। অবশিষ্ট ২২ জনকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়।
Discussion about this post