চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের চকলেট গলিতে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে যুবক মনির। আশপাশের লোকজন তাকে আটক করে পুলিশে দেয়। শিশুটিকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে।
এর তিন মাস আগে জানুয়ারিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে নাজিমউদ্দিনকে আটক করে পুলিশ। যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকার উত্তরপাড়ার একটি বাসায় ওই শিশুর বাবা-মা ভাড়া থাকতেন। ঘটনার দিন বাড়ির পাশের একটি মাঠে শিশুটি খেলা করছিল। এ সময় নাজিমউদ্দিন শিশুটিকে কৌশলে নিজেদের ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে।
শুধু খিলগাঁও কিংবা যাত্রাবাড়ীর এ দুটো ঘটনা নয়- সারাদেশেই শিশুর ওপর এমন যৌন সহিংসতার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১৪৪ শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, এ সংখ্যা চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১৪৫। এ হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে ধর্ষিত হচ্ছে ৪৮ শিশু। ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার শিশু ছিল ৪৪৬ জন। এ সংখ্যা ২০১৫ সালে ৫২১, ২০১৪ সালে ১৯৯, ২০১৩ সালে ১৭০ এবং ২০১২ সালে ৮৬। পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, উদ্বেগজনক হলেও দেশে শিশু ধর্ষণ থামছে না কিছুতেই।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শিশুর ওপর কোনো নির্যাতন বা অবৈধ বল প্রয়োগের কথা জানা গেলে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা চালানো হয়। শিশুর অপহরণকারী ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত অনেককে বিভিন্ন সময় র্যাব গ্রেফতার করেছে।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। এসব ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়।’
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ৪১, ফেব্রুয়ারিতে ৫০ ও মার্চে ৫৩। ধর্ষণ ছাড়াও শিশুরা আরও অনেক রকম নির্যাতনের শিকার হয়। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে শিশু অপহরণ হয়েছে ১৩৮ জন। অপহৃত শিশু উদ্ধারের সংখ্যা ৯৭ জন। এ সময় নানাভাবে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১৩টি। ২০১৬ সালে দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ৬০১টি। শিশু অপহরণ সংখ্যা ৫৭৪টি। অপহৃত শিশু উদ্ধারের সংখ্যা ৩৮১টি। ধর্ষণ করে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ৬টি। শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৭২১টি। তবে গত বছর দেশে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা মাত্র ১৭ জন। একই সময়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় খালাসপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ১৫৮টি।
অন্যদিকে শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে শিশু হত্যার ঘটনা ৮৯টি। বিগত বছরগুলোতে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২০১৬ সালে ২৬৫, ২০১৫ সালে ২৯২, ২০১৪ সালে ৩৬৬, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯টি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে শিশু অপহরণের ঘটনা ৩০টি। এর আগে ২০১৬ সালে ১৮৩, ২০১৫ সালে ২৪৩, ২০১৪ সালে ২০৯, ২০১৩ সালে ৬১ ও ২০১২ সালে ৬৭টি শিশু অপহরণ হয়। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে অপহরণের পর শিশু হত্যার ঘটনা ছয়টি। এর আগে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে- ২০১৬ সালে ১৭, ২০১৫ সালে ৪০, ২০১৪ সালে ৫২ এবং ২০১৩ সালে ১৯টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না তারা। অনেক ক্ষেত্রেই চেনাজানা লোকজনের মাধ্যমে শিশুরা যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড়দের মধ্যে ‘দ্বন্দ্বে’ ‘প্রতিশোধ’ নিতে শিশুর সঙ্গে বর্বর আচরণ করা হয়। এ ছাড়া বিদ্যায়তনেও শিশু নিপীড়ন হয়।
নির্যাতিত একাধিক শিশুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্যাতনের পর শিশুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাসার নেওয়া হলেও তার মধ্যে এক ধরনের ভীতি থেকেই যায়।
অনেক সময় প্রতিবেশীরাও এ ধরনের সহিংসতা বাড়ায়। গত ২৮ এপ্রিল কদমতলী থানার জুরাইন এলাকায় পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে বাড়ির মালিকের ছেলে সাবি্বর। তাকে আটক করে স্থানীয়রা পুলিশে সোপর্দ করে। শিশুটিকে ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় কদমতলী থানায় মামলা করেছে শিশুটির পরিবার।
-সমকাল
Discussion about this post