বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ

বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে জানার আগে পৃথিবীতে প্রাচীন বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। ২৮২টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত এই আইনসমূহে বাণিজ্য, বিবাহ, দাসত্ব, কর্জ ও চৌর্য — সব কিছুই স্থান পেয়েছিল। শাস্তির যে সব বিধান এখানে ছিল, আজকের যুগে সেগুলি বর্বর মনে হবে।
চুরির অপরাধে আঙুল কেটে নেওয়া, বিবাহিত নারীকে কোনও পরপুরুষ চুম্বন করলে তাঁর ঠোঁট কেটে ফেলা, অপবাদ প্রচারের শাস্তি হল জিভ কেটে নেওয়া, বাড়ি ভেঙে পড়ে বাড়ির মালিকের পুত্রের মৃত্যু হলে, গৃহনির্মাতার পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ইত্যাদি।চলুন জেনে নেই পৃথিবীতে প্রাচীন বিচার ব্যবস্থাসহ বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ।
পৃথিবীতে প্রাচীন বিচার ব্যবস্থাঃ-

অন্যায়ের জন্য শাস্তি দেওয়া পৃথিবীতে বহু বছর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। সমাজের প্রধানরা তাঁদের ধর্মীয় বুদ্ধি ও নৈতিক চিন্তাধারা ব্যবহার করে দোষীদের শাস্তি বিধান করতো।ধীরে ধীরে তাঁদের চিন্তাধারা লিখিত রূপ নিয়ে আইন হিসাবে পরিণত হয়। সব দেশেই আইনের সঙ্গে ধর্মের যোগ ছিল না।
যেমনঃ-হামুরাবি ছিলেন ব্যাবিলনের রাজা। ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি সিংহাসনে বসেন।তাঁর রাজত্বকালে বড় বড় পাথরের ওপর এই আইনগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়।প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার আইনসূত্র, যেগুলি ‘কোড অফ হামুরাবি’ বলে পরিচিত, সেগুলি ছিল মোটামুটি ভাবে ধর্ম-নিরপেক্ষ – ধর্ম নীতিবোধের প্রভাব তার ওপর বিশেষ ছিল না।
অনুমান করা হয় যে, তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত মিশর ও চিন দেশেও ধর্ম-নিরপেক্ষ আইনের প্রচলন কিছুটা ছিল। অন্য পক্ষে পুরনো যুগে হিন্দু, ইহুদি, খ্রিশ্চান ও মুসলিম সমাজের আইনের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বেদ-উপনিষদ, বাইবেল ও কোরানের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বাইবেলের ‘টেন কমান্ডমেণ্ট’-এর সঙ্গে যে সব আইনের কথা লেখা হয়েছিল, সেগুলিতে শাস্তির বহরও অনেকটা হামুরাবির বিধানের মতোই কঠোর, যাকে অনেক সময় বলা হয় ‘আই ফোর অ্যান আই, টুথ ফর অ্যা টুথ’ (চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত) জাতীয় চিন্তাধারা-প্রসূত।
বাংলাদেশ বিচার বিভাগের ইতিহাসঃ-

বাংলাদেশের বর্তমান আইন ও বিচার ব্যবস্থা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় দুইশো বছরের বৃটিশ শাসনের কাছে অনেকাংশে ঋণী, যদিও এর কিছু কিছু উপাদান প্রাক-বৃটিশ আমলের হিন্দু এবং মুসলিম শাসন ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশ বিচার বিভাগের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের পুরনো।
বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়
- হিন্দু শাসনকাল,
- মুসলিম শাসনকাল,
- ব্রিটিশ শাসনকাল এবং
- স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়। প্রায় পনের’শ বছর আগে এবং খ্রিস্টীয় যুগ আরম্ভ হওয়ার পরে হিন্দু আমলের বিস্তৃতি ঘটে।
সে সময় প্রাচীন ভারতবর্ষ কতিপয় স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং রাজা ছিলেন প্রত্যেকটি রাজ্যের কর্তা। ন্যায় বিচার প্রসঙ্গে রাজা ন্যায় বিচারের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতেন এবং তাঁর রাজত্বে বিচার প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হতেন।
তৎকালীন রাজাগণ আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। শ্রুতি, স্মৃতি, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ ইত্যাদি আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো। এছাড়াও অর্থশাস্ত্র এবং মনুস্মৃতি ভারতীয় আইনের উল্লেখযোগ্য বিধান হিসেবে বিবেচিত হতো।
ব্রিটিশ শাসনামল আঠারো’শ শতকের মাঝামাঝি হতে শুরু হয়ে প্রায় দুইশ বছর পরিচালিত হয়। ১৬৬১ সালে চার্লস ২য় কর্তৃক প্রদত্ত সনদ অনুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে নিয়ন্ত্রিত ফ্যাক্টরি এবং মাদ্রাজ, বোম্বে ও কলকাতায় অবস্থিত কোম্পানির নিয়ন্ত্রনাধীন ব্যবসায়িক কেন্দ্রসমূহের দেওয়ানি এবং ফৌজদারি উভয় প্রকারের বিচারকার্য ব্রিটিশ আইন দ্বারা পরিচালিত হতো।
১৬৬৮ সালে প্রদত্ত সনদ দ্বারা কোম্পানি বোম্বেতে তাদের শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে আইন তৈরির ক্ষমতা লাভ করে। ১৬৮৬ সালে প্রদত্ত সনদের বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৮৭ সালে মাদ্রাজে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য মিউনিসিপ্যালিটি এবং মেয়র আদালত স্থাপন করে। পরবর্তিতে বোম্বে এবং মাদ্রাজেও একই ধরনের আদালত স্থাপিত হয়।

রাজা প্রথম জর্জ কর্তৃক ১৭২৬ সালে প্রদত্ত সনদ অনুযায়ী কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বের প্রধান শহরগুলোতে ১৭২৮ সালে মেয়র আদালত স্থাপনের সাথে সাথে ভারতবর্ষে আধুনিক বিচারবিভাগের সূচনা হয়। উক্ত সনদে উল্লেখিত ছিলো যে, গভর্ণর এবং কাউন্সিলের পাঁচজন সিনিয়র সদস্য কর্তৃক ফৌজদারি অপরাধের বিচারকার্য সম্পাদিত হবে এবং তারা জাস্টিস অব পিস হিসেবে বিবেচিত হবে।
১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং এ্যাক্ট অনুযায়ী ১৭৭৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে সুপ্রীম কোর্ট স্থাপনের সনদ ইস্যু করা হয়। ১৮৩৪ সাল হতে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে রাজার আদালত এবং কোম্পানীর আদালত নামে দুই ধরনের আদালত বিচারকার্য সম্পাদন করতো। ১৮৩৩ সালের জুডিসিয়াল কমিটি আইন পাশ হবার পর হতে প্রিভি কাউন্সিলের নাম হয় জুডিসিয়াল কমিটি অব প্রিভি কাউন্সিল।
ভারতীয় উপমহাদেশে ১১০০ সালের দিকে মুসলিম শাসনকাল আরম্ভ হয়। মুসলিম বাদশাহগণ রাজ্য পরিচালনা করাকালে পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদিস, ইজমা এবং কিয়াসের আলোকে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। সে সময়ে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য সুলতান কর্তৃক ‘কাজী’ নিযুক্ত হতো এবং সর্বোচ্চ আদালত ছিলো সম্রাটের আদালত যা সম্রাট স্বয়ং পরিচালনা করতেন। সুলতানকে এ কাজে সহায়তা করতেন দুইজন ‘মুফতি’। মুসলিম শাসনামলে আদালতসমূহ দুইটি বিধানের আলোকে পরিচালিত হতো- ফিকহ-ই-ফিরোজ শাহ এবং ফতোয়া-ই-আলমগীরী।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিলোপ সাধিত হয় এবং ইংল্যান্ডের রাজা ভারতবর্ষ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান হাইকোর্ট এ্যাক্ট পাশ করা হয়। উক্ত আইন পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে সুপ্রীম কোর্ট, সদর দেওয়ানী আদালত এবং সদর নিজামত আদালতের বিলোপ সাধিত হয় এবং কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে হাইকোর্ট স্থাপিত হয়।
পরবর্তিতে ১৯১৫ সালে ভারত শাসন আইন পাশ হয় যার মাধ্যমে হাইকোর্টের গঠন, এখতিয়ার এবং ক্ষমতা নির্ধারিত হয়।১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ভারতের হাইকোর্ট হতে প্রদত্ত সিদ্ধান্তের আপীল শুনানীর জন্য ভারতে ফেডারেল আদালত স্থাপিত হয়। কিন্তু উক্ত ক্ষমতা খুবই সীমিত ছিলো কেননা আইনের ব্যাখ্যা এবং ভারত শাসন আইনের ব্যাখ্যা ব্যতীত অন্য সব আপিল প্রিভি কাউন্সিলে দায়ের করা হতো।
১৯৪৭ সালে পাশকৃত হাইকোর্ট অব বেংগল অর্ডার এর ৯ নং ধারা অনুযায়ী ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হয় যার দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য জন্য পৃথক হাইকোর্ট ঢাকাতে স্থাপিত হয়। ১৯৪৭ সালের ফেডারেল কোর্ট অর্ডার অনুযায়ী পাকিস্তানের করাচিতে ফেডারেল আদালত স্থাপিত হয় । ফলে সেসময় থেকে প্রিভি কাউন্সিলে আপিল দায়েরের পরিবর্তে পাকিস্তানের ফেডারেল আদালতে আপিল দায়ের করা শুরু হয়।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার ফলে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে ফেডারেল আদালতের পরিবর্তে সুপ্রীম কোর্ট বিবেচিত হয়।১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ল’স কন্টিনিউএন্স এনফর্সমেন্ট অর্ডার,১৯৭১ পাশ করা হয় যার ফলে বাংলাদেশে ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এর পূর্বে পাশকৃত সকল আইন বলবত করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭৪০ টি আইন, ৫০৭ টি অধ্যাদেশ এবং বহু রেগুলেশন প্রচলিত রয়েছে।
পাকিস্তান গণপরিষদ ‘প্রিভি কাউন্সিল (অধিক্ষেত্র বাতিল) আইন, ১৯৫০’ পাশ করে যা পাকিস্তানের ফেডারেল আদালত হতে প্রিভি কাউন্সিলে আপীল দায়েরের ব্যবস্থাকে বাতিল করেছিল। ১৯৫৬ সালে নতুন সংবিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে এর আওতায় প্রদেশসমূহে হাই কোর্ট এবং কেন্দ্রে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফেডারেল আদালত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে কাজ করেছে।
পাকিস্তানের এ সংবিধান ১৯৫৮ সালে বাতিল করা হয়েছিল এবং ১৯৬২ সালে নতুন আরেকটি সংবিধান চালু করা হয়, কিন্তু সমগ্র বিচার কাঠামো একই রয়ে যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি সংবিধান গ্রহণ করে যাতে আপীল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রীম কোর্টের গঠন প্রণালি ও কার্যক্রম বর্ণনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের অধঃস্তন বিচার বিভাগ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি ব্যবস্থা উভয়ের উৎপত্তি হয়েছিল দেওয়ানী আদালত আইন, ১৮৮৭ এবং ফৌজদারী কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ থেকে। এছাড়াও বাংলাদেশে আরো কতিপয় অন্যান্য বিশেষ আইন আছে, যা কিছু বিশেষ আদালতের ভিত্তিস্বরূপ কাজ করে, যেমন – শ্রম আদালত, শিশু অপরাধ আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ইত্যাদি।
লেখকঃ ল ফর ন্যাশনস, ইমেইলঃ lawfornations.abm@gmail.com, মোবাইল: 01842459590.
আইন কি? আইন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত পড়ুন
তাছাড়া আরও পড়ুন–পদ্ধতিগত আইন এবং সংক্ষিপ্ত আইনের মধ্যে পার্থক্য
Discussion about this post