বিডি ল নিউজঃ বিএনপিকে ভেঙে ‘নতুন বিএনপি’ গড়ার লক্ষ্যে গোপনে তৎপরতা চলছে বলে জানা গেছে। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।
নতুন বিএনপি গড়ার এই উদ্যোগে এখন পর্যন্ত সামনে আছেন বিএনপির সাবেক দুই সাংসদ আবু হেনা ও শহীদুল হক জামাল। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তাঁরা সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁদের দাবি, বিএনপির সাবেক বেশ কয়েকজন সাংসদ তাঁদের সঙ্গে আছেন।
এর মধ্যে গত ৪ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সমালোচনা করার একপর্যায়ে বলেছিলেন, ‘ওনার দলের অনেক সাবেক এমপির সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তাঁরাও এ রকম কর্মকাণ্ড পছন্দ করছেন না।’
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি একটি সূত্র থেকে জানা যায়, মূলত আবু হেনা ও শহীদুল হক জামাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু হেনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক-দুবার দেখা হয়েছিল।’ এটা নতুন কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগের অংশ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো চিন্তা করছি, সবকিছু এখনো অস্পষ্ট। দেখা যাক, কিছু করা যায় কি না।’
আর শহীদুল হক জামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর একবার দেখা হয়েছিল। সেটা কিছুদিন আগে। বিএনপিকে ভেঙে নতুন কোনো দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চিন্তাভাবনা করছি, কী করা যায়। আমাদের সঙ্গে বিএনপির অনেক সাবেক এমপি আছেন।’
শহীদুল হক জামাল আরও বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও অবস্থানের কথা গতকাল (শনিবার) লেক শোর হোটেলে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল অনুষ্ঠানে বলেছি। আমার পরিষ্কার বক্তব্য হচ্ছে, জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-সন্ত্রাস করে গণতন্ত্র টেকে না।’
সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ওই গোলটেবিল আলোচনায় আবু হেনাও বক্তৃতা করেন। এতে বেশির ভাগ বক্তাই বিএনপিকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠী এবং তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে আখ্যায়িত করে দলটির সঙ্গে সংলাপ না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এর এক দিন আগে ৫ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি না এলে দলটির অনেক বড় মাপের নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। ইতিমধ্যে বিএনপির অনেকেই যোগাযোগ শুরু করেছেন।
অবশ্য হাছান মাহমুদ বিএনপি ভাঙার তৎপরতায় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানের মতো দল ভাঙার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তবে বিএনপির নেতাদের মতে, দলটির বর্তমান দুর্দশার জন্য তারেক রহমান তো বটেই, খালেদা জিয়াও দায়ী। তিনি বলেন, সারা দেশে পেট্রলবোমা, সন্ত্রাস, সহিংসতার কারণে বিএনপির অনেক নেতা ক্ষুব্ধ হয়ে নতুন প্ল্যাটফর্ম করতে পারেন। তাঁদের অনেক নেতা ব্যক্তিগত আলাপে এমন মত প্রকাশ করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপিকে ভাঙার নতুন এ উদ্যোগে এখনো পর্যন্ত দলটির গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতাকে পাওয়া যায়নি। তবে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত এবং অনেক দিন ধরে বিএনপির রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন বা বহিষ্কৃত সাবেক সাংসদ ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতাদের এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। আর এ ক্ষেত্রে সংগঠকের ভূমিকায় আছেন সাবেক হুইপ বরিশালের শহীদুল হক জামাল এবং রাজশাহীর বাগমারা-মোহনপুর আসনের সাবেক সাংসদ আবু হেনা।
এর মধ্যে আবু হেনা ২০০৪ সালে খালেদা জিয়ার তৎকালীন সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের ঘোষিত ‘ট্রাম্প কার্ড’-এর অংশ হিসেবে বিএনপির একদল সাংসদকে সংসদ থেকে পদত্যাগ করানোর ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় প্রথম আলোচনায় আসেন। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সে সময় ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপির তৎকালীন সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন যে না হলে ওই দিনে তাঁরা ট্রাম্প কার্ড দেখাবেন।
এর আগে ২০১৩ সালেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সরকার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা চালিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তখন ওই উদ্যোগের নেপথ্যে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয় ছিল। তবে তাঁরা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ বা কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকে যুক্ত করতে পারেননি, যে কারণে ওই তৎপরতা সফল হয়নি। এখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ৬২ দিন ধরে টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ‘নতুন বিএনপি’ গড়ার নামে দলটিতে ভাঙন ধরাতে সরকার আবার তৎপর হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকার অনেক কৌশল অবলম্বন করতে পারে। এর মধ্যে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টাও থাকতে পারে। এ ধরনের চেষ্টা অতীতেও হয়েছে, কিন্তু সফলতা আসেনি।
এদিকে নতুন বিএনপির উদ্যোক্তারা আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অংশ নেওয়ার চিন্তা করছেন বলে তাঁদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়। সম্ভাব্য এই নির্বাচনের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে আবু হেনা ও শহীদুল হক জামাল ২ মার্চ নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। শহীদুল হক ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার ভোটার।
শহীদুল হক জামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারও পক্ষ থেকে নয়, একজন সাবেক হুইপ ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে আমি নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। ভোটার তালিকা ছাপা হয়েছে কি না, কবে ভোট হবে, সীমানা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম।’ প্রার্থী হচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘সময়মতো’ জানানো হবে।
এদিকে প্রথম আলোর বাগমারা (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, ২০০৫ সালে সাংসদ আবু হেনা তৎকালীন আইনমন্ত্রী আমিনুল হক ও নাটোরের সাংসদ রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের (দুলু) বিরুদ্ধে জঙ্গি নেতা বাংলাভাইকে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলেছিলেন। এ ঘটনায় তিনি তখন ব্যাপক আলোচনায় আসেন এবং ওই বছরের নভেম্বরে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকেই বাগমারা-মোহনপুর আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে আলাদাভাবে বিএনপির যে তৎপরতা চলেছিল, তাতে অন্য অনেকের সঙ্গে আবু হেনা ও শহীদুল হক জামালও যুক্ত ছিলেন। সংস্কারপন্থী নেতাদের অনেককে পরে দলে নিলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় বহিষ্কার করা হয়েছিল জামাল ও হেনাকে।
অবশ্য হেনা দাবি করেন, তাঁকে বহিষ্কার করা হলেও ২০০৭ সাল থেকে তিনি আবার বিএনপিতে আছেন। আর শহীদুল হক বলেন, বহিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে বিএনপির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই।
সূত্রঃ প্রথম আলো




Discussion about this post