সরকারি কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করে বিচারকদের বেতন-ভাতাও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। “অষ্টম পে-স্কেলের সঙ্গে সমন্বয় করে বিচারকদের বেতন ও জুডিশিয়াল ভাতা শিঘ্ররই ঘোষণা করা হবে।” গতকাল শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।<br /> গত ১৫ ডিসেম্বর সরকারি চাকরিজীবীদের অষ্ঠম বেতন-কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। সরকারি চাকরীজীবীদের বেতন বিভিন্ন গ্রেডে ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।<br /> নিম্ন আদালতের বিচারকদের বেতন-ভাতা সর্বশেষ ২০১৩ সালে বাড়ানো হয়েছিল। এরপর গত অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের পাশাপাশি উচ্চ আদালতের বেতন-ভাতা বাড়াতে খসড়া আইনে সায় দেয় মন্ত্রিসভা।<br /> এছাড়া গত মে মাসে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন নিম্ন আদালতের বিচারকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করে। কিন্তু ওই সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘ দিনেও তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিচারকরা।<br /> এরই মধ্যে আইনমন্ত্রী শিগগিরই বিচারকদের পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিয়ে আরও বলেন, ‘এর ফলে বিচারকরা আর্থিকভাবে যেরকম লাভবান হবেন, পাশাপাশি মর্যাদাও বাড়বে।’ অনুষ্ঠানে উচ্চ এবং নিম্ন আদালতের সব বিচারক অংশ নেন।</p> ত মে মাসে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন নিম্ন আদালতের বিচারকদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বৃদ্ধির সুপারিশ করে । কমিশন জ্যেষ্ঠ জেলা জজদের বেতন ৮৪ হাজার টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ্ জেলা জজ হিসেবে ৫ বছর দায়িত্ব পালনকারীরা এই বেতন পাবেন। তবে জেলা জজ হিসেবে যারা ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেননি তাদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা, অতিরিক্ত জেলা জজ ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাগণ ৭০ হাজার, যুগ্ম জেলা জজ ৬২ হাজার, সিনিয়র সহকারী জজ ৫২ হাজার, সহকারী জজ ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিলেকশন গ্রেড ৪২ হাজার এবং সহকারী জজ ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার টাকা মূল বেতনের সুপারিশ করা হয়েছে।<br /> বর্তমানে জ্যেষ্ঠ জেলা জজদের সর্বোচ্চ মূল বেতন ৪০ হাজার টাকা এবং সহকারী জজ হিসেবে প্রবেশ পদে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা। বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা জজদের মূল বেতন ৩২ হাজার, যুগ্ম জেলা জজ ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ২৮ হাজার, সিনিয়র সহকারী জজ ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ২৩ হাজার ও সহকারী জজদের সিলেকশন গ্রেডের ক্ষেত্রে ১৮ হাজার টাকা রয়েছে। অর্থাত্ পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে নিম্ন আদালতের বিচারকরা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ বেতন-ভাতা পাবেন।<br /> এ প্রসঙ্গে কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেছেন, আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচারকদের জন্য উচ্চতর বেতন ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিচারালয় হলো ন্যায় বিচার প্রাপ্তির সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। জনগণ বিচারকদের নিকট হতে যথাযথ ন্যায় বিচার আশা করে বিধায় তারা অন্য সার্ভিসের চেয়ে বিচারকগণের উন্নততর জীবন যাপনও প্রত্যাশা করে। তাই জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন মনে করে, জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিচার বিভাগের দক্ষতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি এবং এ বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচারকগণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।<br /> বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়। পৃথকীকরণের আগেই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার বিষয়ে জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা-২০০৭ জারি করে সরকার। এই বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বিচারকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন।<br /> ওই বিধিমালা অনুযায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু বিচারকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত ২০০৯ সালে পেশ করা ওই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে চেয়ারম্যান করে সাত সদস্যের জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশন তাদের পঞ্চম সভায় অধস্তন আদালতের বিচারকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে করা সুপারিশ ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছেন। এখন কমিশনের এই সুপারিশ বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছেন বিচার-বিভাগীয় কর্মকর্তারা।<br /> পে-কমিশনের সুপারিশে মাসিক মূল বেতনের শতকরা ৩০ ভাগ হারে জুডিসিয়াল ভাতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাত্ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সকল পর্যায়ের সদস্যদের অর্থাত্ সার্বক্ষণিক বিচারিক কাজে, প্রেষণে বা অন্যবিধভাবে কর্মরত রয়েছেন তাদেরকে মাসিক মূল বেতনের ৩০ ভাগ হারে জুডিসিয়াল ভাতা প্রদান করতে হবে। এই ভাতার অন্য কোন নাম দেয়া যাবে না।<br /> এ প্রসঙ্গে কমিশনের সদস্য হাইকোর্টের বিচারক বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান সভায় বলেন, ২০০৯ সালে জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন যেহেতু মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থাৎ শতভাগ ভাতা প্রদানের সুপারিশ করেছিল এবং আদালত কর্তৃক ৩০ ভাগ নির্ধারিত করা হয়েছে, সেহেতু বিচারিক ভাতা ৩০ ভাগ নির্ধারণ করাই সমীচীন।<br /> জুডিসিয়াল ভাতা ছাড়াও ঢাকা মেট্টোপলিটন এলাকার জন্য মূল বেতনের (৩৫ হাজার থেকে ৫১ হাজার ৯৯৯ টাকার স্কেল পর্যন্ত) ৬০ ভাগ হারে ন্যূনতম ৩০ হাজার টাকা, জেলা শহরের জন্য ৪৫ ভাগ অর্থাৎ্ ন্যূনতম ২০ হাজার এবং অন্যান্য স্থানের জন্য ৪০ ভাগ হারে ১৮ হাজার টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর মেট্টোপলিটন এবং কক্সবাজার ও পৌর এলাকার জন্য ৫০ ভাগ হারে ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা পাবেন।<br /> এছাড়া ৫২ হাজার ও এর ঊর্ধ্বে বেতন স্কেলে ঢাকা মেট্টোপলিটন এলাকার জন্য মূল বেতনের ৫০ ভাগ হারে ন্যূনতম ৩৫ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা, জেলা শহরের জন্য ৪০ ভাগ হারে অর্থাত্ ন্যূনতম ২৭ হাজার ও সর্বোচ্চ ৩২ হাজার টাকা এবং অন্যান্য স্থানের জন্য ৩৫ ভাগ হারে ন্যূনতম ২২ হাজার ও সর্বোচ্চ ২৮ হাজার টাকা মাসিক বাড়ি ভাড়ার ভাতা পাবেন। তবে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর মেট্টোপলিটন এবং কক্সবাজার ও পৌর এলাকার জন্য ৪৫ ভাগ হারে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার টাকা পাবেন। পোশাক ভাতা ১০ হাজার, লাইব্রেরি ভাতা ১৫ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন ভাতা প্রাপ্ত হবেন বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।<br /> লাইব্রেরি ভাতা প্রসঙ্গে আইন কমিশনের সদস্য ড. এম শাহ আলম বলেন, জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের প্রচুর আইন বই, আইন সাময়িকী পাঠ করতে হয়। জেলা জজ আদালতের পুস্তক ক্রয়ের সরকারি বরাদ্দ অপ্রতুল। এজন্য এই সার্ভিসের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য পুস্তক ভাতা প্রবর্তন করা দরকার।<br /> সুপারিশে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যগণ রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন বিধায় তাদের সাথে অন্যান্য সার্ভিসের বেতনের সমতা বা তুলনা হতে পারে না। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের চেতনা ও অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবনের মাধ্যমে এবং ওই রায়ের প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকেই জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যগণের বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন।</p>




Discussion about this post