উৎসব ভাতা থেকে বঞ্চিত করায় ২০০৭ সালের ২১ মে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার দিলদারপুর টি এস্টেটের (চা-বাগান) বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম দ্বিতীয় শ্রম আদালতে মামলা করেন বাগানটির কর্মচারী এস কে সরকার। এরপর সাড়ে নয় বছর কেটে গেছে, কিন্তু মামলার সুরাহা এখনো হয়নি।
এস কে সরকারের আইনজীবী মো. সেলিম গণমাধ্যমকে বলেন, মামলাটি এখন যুক্তি-তর্ক শুনানির জন্য রয়েছে। গত পাঁচ মাসে চারবার এই মামলার তারিখ পড়েছে, কিন্তু বিচারক না থাকায় শুনানি হয়নি।
দিলদারপুর টি এস্টেটের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী আশীষ কুমার দত্ত বলেন, শ্রম আদালত বছরের বেশির ভাগ সময় বিচারকশূন্য থাকে। এ কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগছে।
এস কে সরকারের মতো অনেক শ্রমিকই মামলা নিষ্পত্তির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন। অথচ আইন অনুযায়ী ৬০ কর্মদিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ হওয়ার কথা। চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে বর্তমানে ১ হাজার ৭০৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রম আদালতে মামলা রয়েছে ১ হাজার ৫৭টি এবং দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৬৫১টি। চট্টগ্রাম জেলা ছাড়াও চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলা। দ্বিতীয় শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট।
আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ দুই মাসে ২৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, দ্বিতীয় শ্রম আদালতে কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি।
চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতে বিচারক (চেয়ারম্যান) থাকলেও দ্বিতীয় শ্রম আদালতে পাঁচ মাস ধরে বিচারক নেই। এর আগে প্রথম আদালতের বিচারকের পদটিও প্রায় ছয় মাস (২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) শূন্য ছিল। চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বিচারক মোক্তার হোসেন প্রথম শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর ২৯ মার্চ থেকে দ্বিতীয় শ্রম আদালতের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরের কাতালগঞ্জের একটি সরকারি বাড়িতে শ্রম আদালতের কার্যক্রম চলে।
চাকরিতে পুনর্বহাল, পাওনা আদায়, মালিক-শ্রমিক চুক্তির লঙ্ঘন, বেতন-ভাতার দাবি, ক্ষতিপূরণ আদায় ও ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত মামলা শ্রম আদালতে করা হয়। জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক শ্রম আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে বিচারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রতি দুই বছর পর পর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয় ছয়জন করে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়।
আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচারকশূন্যতা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে বিলম্ব, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে বিলম্বের কারণে শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলার বিচার ঝুলে আছে।
বিচারকের পাশাপাশি তিন বছর ধরে চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতেই রেজিস্ট্রার নেই। প্রথম শ্রম আদালতের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা তারিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, বিচারকশূন্যতা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।
অবশ্য এই আদালতের মালিক প্রতিনিধি মো. মহসীন চৌধুরী দাবি করেন, তিনি নিয়মিত আদালতে উপস্থিত থাকেন। দ্বিতীয় শ্রম আদালতের শ্রমিক প্রতিনিধি শেখ মো. লোকমান হোসেন বলেন, শ্রমিক প্রতিনিধিরা ঠিকমতো উপস্থিত হন, কিন্তু বিচারক না থাকার কারণে মামলা ঝুলে থাকছে।
চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক নিরাপত্তা প্রহরী মো. ইয়াসিন। তিনি বলেন, আট বছর ধরে তাঁর মামলাটি ঝুলে আছে।
আইনজীবীরা জানান, শ্রম আদালতে মামলা করার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে কী হবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ঢাকায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যায়।
-প্রথম আলো
Discussion about this post