ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও আসামিকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পুর্ণাঙ্গ রায় শিগগিরই প্রকাশ হতে যাচ্ছে। রায়ের কপি ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে, চলছে বানান দেখার কাজ।
আজ বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) এ রায়টি প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। ঐতিহাসিক এ রায়কে কেন্দ্র করে সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় চলছে নানা ধরনের কানাঘুষা। এ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে আদালত পাড়ায় ভিড় করছেন মিডিয়া কর্মীরা। আজ রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ হতে পারে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ বলেন, ‘আজ এ রায় প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কত পৃষ্ঠার রায় সে বিষয়টি তিনি পরিষ্কার করেননি। তিনি বলেছেন রায় প্রকাশের সবকিছুই সম্পন্ন করা হয়েছে, বাদ রয়েছে প্রুফ দেখার কাজ।
গত ২৪ মে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ফৌজদরী কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৪ ধারা নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখেন।’
বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও পুলিশি রিমান্ড প্রশ্নে ১৩ বছর আগে দেয়া হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায় বহাল রেখে গত ২৪মে আপিলের রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করে এই রায় দেয়। তবে প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, হাইকোর্টের রায়ের কিছু সংশোধনী দেয়া হবে।
৫৪ ধারার অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়েরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষের আইনজীবী ড. কামাল হোসেন আপিল বিভাগের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দী থেকে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, পৃথিবীর কোথাও সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় না। সাদা পোশাকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে আমাদের দেশে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। শত্রুতাবশত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে গায়েব করার ঘটনাও রয়েছে। আশা করি, আপিল বিভাগের এই রায়ের মাধ্যমে এটা বন্ধ হবে।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মান্য করতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, কেউ যদি নির্দেশনা অমান্য করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ এ রায়ের কপি আজ প্রকাশ হলে এটি চলে যাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে।
এরআগে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় প্রেপ্তার এবং ১৬৭ ধারায় পুলিশ রিমান্ড প্রশ্নে রাষ্ট্রের আপিল খারিজ করে দেয়।
যা ছিলো হাইকোর্টের রায়ে
নির্দেশনাগুলো হলো- ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় প্রেপ্তার করতে পারবে না। খ. কাউকে প্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ. প্রেপ্তারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে। ঘ. প্রেপ্তারকৃতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ। ঙ. প্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে প্রেপ্তারকৃতকে এর কারণ জানাতে হবে। চ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে প্রেপ্তারকৃতের নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। ছ. প্রেপ্তারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়র সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। জ. প্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। ঝ. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। ঞ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে। ঠ. পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে প্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে। ড. পুলিশ বা কারাহেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয় ওই ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেবেন।
যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই মামলা
১৯৯৮ সালে ডিবি পুলিশ ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় প্রেপ্তার করে। পরে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় রুবেল মারা যান। পুলিশ হেফাজতে রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের রিট আবেদন দায়ের করে। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মো. হামিদুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় প্রেপ্তার ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার বিধান ৬ মাসের মধ্যে সংশোধনে এক যুগান্তকারী রায় দেন।
Discussion about this post