পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু আক্তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক হওয়া আবু নাছের গুন্নুকে (৪৫) মাজারকেন্দ্রিক বিরোধে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাজারের আধিপত্য নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধক মূসাবিয়ার দুই মেয়ের মধ্যে বিরোধের জেরে এক মেয়ের অনুসারী গুন্নুকে স্পর্শকাতর এ মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গুন্নু কখনোই ছাত্রশিবিরের রাজনীতি এবং জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলেও দাবি করেছেন মাজার পরিচালনা কমিটির একাংশের নেতারা। আর গুন্নুকে হয়রানির সঙ্গে সরকারি দলের স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নেতাও জড়িত বলে দাবি করেছেন তারা।
হাটহাজারী উপজেলার নাজিরহাট এলাকার কাছাকাছি ফরহাদাবাদ ইউনিয়নে আধ্যাত্মিক সাধক শেখ আহমদুল হক সিদ্দিকীর মাজার। আধ্যাত্মিকভাবে প্রাপ্ত নাম মূসাবিয়ার অনুসারে মাজারটি ‘মূসাবিয়ার মাজার’ হিসেবে পরিচিত। মাজারটির প্রকৃত নাম আস্তানা ই পাক দরবার ই মূসাবিয়া।
মঙ্গলবার (০৭ জুন) গভীর রাতে আবু নছর গুন্নুকে মূসাবিয়ার মাজার থেকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর বুধবার নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, নছর সাবেক শিবির নেতা। সে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। মিতু আক্তার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সে যুক্ত থাকতে পারে, এই সন্দেহে তাকে আটক করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূসাবিয়ার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে শামসুন্নুর মনিরা সিদ্দিকা এবং ছোট মেয়ে হামিদুন্নেছা সিদ্দিকা। বড় মেয়ের স্বামী শেখ তৈয়বউল্লাহ সিদ্দিকী মূসাবিয়ার আপন ছোট ভাইয়ের ছেলে। আর ছোট মেয়ের স্বামী বেঁচে নেই।
সূত্রমতে, ৩৪ বছর ধরে ছোট মেয়ের পরিবার মাজার রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বড় মেয়ের স্বামী তৈয়বউল্লাহ মাজারে প্রবেশ করেন। এ নিয়ে দুপক্ষে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে দ্বন্দ্ব চলে আসছে।
বড় মেয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এলাকার ব্যবসায়ী-সমাজসেবকদের একটি অংশ। ছোট মেয়ের পক্ষে আছেন রাজনীতিসংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরা।
স্থানীয় ডেকোরেশন ব্যবসায়ী আবু নছর গুন্নু বড় মেয়ের অনুসারী। তিনি বড় মেয়ের পক্ষে মাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বড় মেয়ের স্বামী তৈয়বউল্লাহ একই কমিটির সভাপতি।
ছোট মেয়ের পক্ষে আলাদা কমিটি আছে। এর সভাপতি পদটি শূন্য আছে। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন রেজোয়ান চৌধুরী।
হাটহাজারী থানার ওসি মো.ইসমাইল হোসেন বলেন, মাজারের কর্তৃত্ব নিয়ে দুই বোনের মধ্যে ভয়াবহ দ্বন্দ্ব আছে। ছোট বোন বড় বোনকে কোন ছাড় দিতে চায়না। আবার বড় বোন ছোট বোনকে কোন ছাড় দিতে চায়না। একপক্ষ সবসময় আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসে। মাজারের পরিচালনা কমিটিও দুইটা। কমিটির একপক্ষ আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে লেগেই আছে।
দ্বন্দ্বের কারণে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মাজারের ওরশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেয়ার কথাও জানিয়েছেন ওসি।
বড় মেয়ের স্বামী তৈয়বউল্লাহর নেতৃত্বাধীন মাজার পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো.আব্দুল করিম বলেন, গত সেপ্টেম্বরে আমরা মাজারে ঢোকার পর থেকে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে। তারা এতদিন ধরে দরবারে লুটপাট চালিয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করায় আমাদের বিরুদ্ধে ১৫-১৬টা মামলা দেয়া হয়েছে। গুন্নু ভাইও কয়েকটা মামলার আসামি।
গুন্নু শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশ্নই উঠেনা। তার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। পরে দেশে ফিরে ডেকোরেশনের ব্যবসা করতেন। তার বিরুদ্ধে কোনদিন কোন মামলা ছিলনা। মাজার পরিচালনা কমিটিতে ঢোকার পর থেকে একের পর এক মামলা হচ্ছে।
‘দরবারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় এরকম চার-পাঁচজন প্রভাবশালী লোক আছে। ঢাকার মহিলা আওয়ামী লীগের এক নেত্রী আছেন। তারাই গুন্নু ভাইকে হয়রানি করছেন। আর মূসাবিয়া হুজুরের ছোট মেয়ে বড় মেয়েকে সহ্য করতে পারেন না। এ সুযোগে নগর গোয়েন্দা পুলিশকে দিয়ে মিতু আক্তার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গুন্নু ভাইকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। বাস্তবে তিনি কখনোই শিবির কিংবা কোন ধরনের জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ’ বলেন আব্দুল করিম।
মিতু আক্তার হত্যাকাণ্ডের দিন (৫ জুন) ভোরে গুন্নু নগরীতে ছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, ঘটনার সময় তিনি দরবারেই ছিলেন। দরবারে সাতজন পুলিশ ও ৩০ জন আনসার সবসময় থাকেন। তাদেরজিজ্ঞেস করা হোক, গুন্নু ভাই ওই ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন ?
আটকের পর নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে গুন্নুর হাজির থাকার বিষয় অনুমান করে এবং কিছু তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়েছে।
গুন্নুর বিরুদ্ধে নাশকতা কিংবা জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কোন অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে হাটহাজারী থানার ওসি ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ কখনোই আমার কাছে আসেনি। আমি উনাকে চিনি। তিনি শিবির কিংবা জঙ্গি, এটা প্রথম শুনলাম। এটা যারা গ্রেফতার করেছে তারাই ভাল বলতে পারবে, আমি জানিনা।
গুন্নুকে আটকের অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের মোকতার আহমেদ। এ বিষয়ে জানতে তাকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি বারবার কেটে দেন।
৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় নগরীর ও আর নিজাম রোডে দুর্বৃত্তদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত ও গুলিতে নিহত হন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী খুন হওয়ার ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে সারা দেশে।
Discussion about this post