মানবিক বিয়ে যুক্তরাজ্যে বহুল প্রচলিত একটি বিষয়। প্রতি বছর ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে এক হাজার মানবিক বিয়ে হয়। অনেকেই এখন মানবিক বিয়ের প্রতি ঝুঁকছেন।‘বিয়ে একটা খেলা, ডিভোর্স যার অন্ত’ কথাটা বলেছেন এমন এক জার্মান আইনজীবী, যিনি একা ৬০ হাজার বিবাহবিচ্ছেদের মামলার দায়িত্বে ছিলেন৷ তাঁর মতে মানুষজন বিয়ে করেই এই ভেবে যে, ঠিকমতো না চললে ডিভোর্স করে দেওয়া যাবে৷
মানবিক বিয়ের সংজ্ঞা:-
মানবিক বিয়ে অনেক ফলপ্রদ হতে পারে আবার অনেকের জন্য মানবিক বিয়ে খারপ পরিণতি এনে দেয়। বিয়ে ও মানবিক বিয়ের যে প্রধান পার্থক্য আছে তা হলো একটিতে ধর্মীয় রীতি মানা হয় আর একটিতে মানা হয় না্। অনেকে আইনগত বিয়ে পচ্ছন্দ করেন আবার অনেকে মানবিক বিয়েতে বিশ্বাসী।
এ্ ধরনের বিয়েতে দুজনের ভালোবাসাই প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে দেশের বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ও ধর্মীয় রীতি নীতি না মেনে যে বিয়ে হয় মূলত সেই বিয়েই হলো মানবিক বিয়ে। যেকোনও দিন যেকোনও সময় এই বিয়ে হতে পারে।
বিয়েতে যেমন অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে মানবিক বিয়ে পুরোপুরি তার বিপরীত। কোন বাঁধা ধরা নিয়ম ছাড়াই মানবিক বিয়ে হয় যেখানে শুধুমাত্র দুজনের প্রতি দুজনের ভালোবাসা প্রাধান্য পায়।
মানবিক বিয়ের পদ্ধতি:-
প্রতীকী কাজ মানবিক বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যেমনঃ- (১) দুজনের উপস্থিতি (২) পরিচিতি (৩) ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বাদে প্রেম ও ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি (৪) পরিচিতি পর্ব (৫) গান বা কবিতার আয়োজন (৬) দম্পতির প্রতিশ্রুতি (৭) অর্থপূর্ণ প্রতীকী কাজ (৮) আংটি বিনিময় (৯) বিবাহের পর আনন্দ উল্লাস (১০) শুভেচ্ছাবাণী (১১) সমাপ্তি । যেটি বর্তমানে বাংলাদেশী আইন অনুযায়ী একটি অপরাধ এবং বিবাহটি শতভাগ অবৈধ মানবিক বিবাহ।

মানবিক ডিভোর্সঃ-
প্রমাণপত্র ছাড়া যে ধরণের মানবিক বিবাহের ডিভোর্স হচ্ছে বর্তমান আইন অনুযায়ী সেগুলোকে মানবিক ডিভোর্স বলা হচ্ছে। সারা দেশে এই ধরণের মানবিক বিবাহ নিয়ে চলছে তূমুল সমালোচনা । ইসলাম অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্ন হলেও বাংলাদেশের বিবাহ বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন আইনে বিবাহের অবশ্যই রেজিষ্ট্রেশন সম্পন করতে হবে । অন্যথায় অপরাধীকে অবশ্যই আইনের আওতায় সাজাভোগ করতে হবে ।
জাতীয় মহিলা পরিষদ নারীদের তালাকের ক্ষেত্রে প্রধানত চারটি কারণকে চিহ্নিত করেছে৷এগুলো হলো: যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং স্বামীর পরনারীতে আসক্তি৷ পুরুষরা কেন স্ত্রীকে তালাক দেয় তা নিয়ে এরকম কোন আলাদা গবেষণার জানা যাই ৷স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এমন কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে কথা বলা জানা যায় তারা প্রধানত স্ত্রীর ‘চরিত্র দোষকেই’ দায়ী করতে চান৷ আর এথেকে একটি বিষয় এখন স্পষ্ট যে ‘পরনারী’ বা ‘পরপুরুষে’ আসক্তির অভিযোগ বাড়ছে৷ এজন্য কেউ কেউ পাশের একটি দেশের হিন্দি এবং বাংলা টেলিভিশন সিরিয়ালকে দায়ী করতে চাইছেন৷ তাদের কথা হল এইসব সিরিয়ালের প্রধান উপজীব্যই হল ‘পরকীয়া প্রেম৷

ডিভোর্সের নিয়ম
মূখে মূখে তিন বার “তালাক” শব্দটি উচ্চারণ করলে বা একসাথে “বায়েন তালাক” শব্দটি উচ্চারণ করলে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ সাথে সাথে কার্যকরী হয় না। এমনকি, মূখে উচ্চারণ ব্যতিত লিখিতভাবে তালাক দিলেও তা সাথে সাথে কার্যকরী হবে না।
১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী বা সংশ্লিষ্ট নিকাহ্ রেজিস্টার বা কাজীর মাধ্যমে তালাক দিতে হবে এবং তালাকের নোটিশ স্ত্রী’কে ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পৌরসভা চেয়ারম্যান/সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানকে পাঠাতে হবে।
মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ণ বয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিষ্কের স্বামী যে কোন সময় কোনরূপ কারণ ব্যতিরেকেই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর ক্ষমতা একচ্ছত্র, কিন্তু এজন্য আইনের বিধান মেনেই তা করতে হবে। বিধান না মানা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
স্বামী কর্তৃক স্ত্রী কে তালাক দেবার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ (১) ধারায় বলা হয়ে, কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে, তিনি যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথা শীঘ্র সম্ভব চেয়ারম্যানকে (স্থানীয় ইউনিয়ন/পৌর চেয়ারম্যান/প্রশাসক) লিখিতভাবে নোটিশ দিবেন এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের একটি অনুলিপি (নকল) প্রদান করবেন।
একই আইনের ৭ (২) ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি নোটিশ প্রদানের এই বিধান লঙ্ঘন করেন তবে তিনি এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডনীয় হবেন।
৭ (৪) ধারা অনুযায়ী, নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন এবং উক্ত সালিশি পরিষদ এই জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৭ (৩) ধারা অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কার্যকরী হবে না। কিন্তু, তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকে, তাহলে ৭(৫) ধারা অনুযায়ী গর্ভাবস্থা অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবত হবে না।
উল্লেখ্য যে, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ -এর ৭(১) নং ধারা অনুযায়ী স্বামী যদি চেয়ারম্যান এবং স্ত্রীকে নোটিশ প্রদান না করে তাহলে ৭ (২) ধারা অনুযায়ী স্বামী শাস্তি পাবে ঠিকই, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। উক্ত তালাক কার্যকর হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে অধ্যাদেশের কোথাও নোটিশ প্রদান না করলে তালাক হবে না এই বিধান উল্লেখ নাই। এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সিভিল রিভিশন নং ৬৯৮, ১৯৯২, মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বনাম মোছা:হেলেনা বেগম ও অন্যান্য।
অন্যদিকে, সালিশি পরিষদ কর্তৃক যদি সমঝোতা না হয় এবং নোটিশ দেবার ৯০ দিনের মধ্যে স্বামী যদি নোটিশ প্রত্যাহার না করে, তবে ৯০ দিন পরে তালাক কার্যকরী হবে। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রী কে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন ১৯৭৪ এর ৬ ধারা অনুসারে বিয়ের মতো তালাকও রেজিস্ট্রি করতে হয়। এখতিয়ারভুক্ত নিকাহ নিবন্ধক অর্থাৎ কাজী নির্ধারিত ফি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন এবং ফি ব্যতীত রেজিস্ট্রির প্রত্যয়ন কপি প্রদান করবেন।
পরিশেষে বলা যায়, মানবিক বিবাহ বাংলাদেশের প্রচলিত বিবাহ বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী একটি নিয়ম বৈহিভূত বিবাহ এবং দন্ডনীয় অপরাধ। সে সাথে মানবিক বিবাহের ফলে ডিভোর্সের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা জটিলতা । বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা না থাকলে ডিভোর্স ও সম্পন্ন করতে হবে মানবিক ভাবে। সুতরাং মানবিক বিবাহকে না বলুন । ধন্যবাদ
lawfornations.abm@gmail.com, মোবাইল: 01842459590.
আইন কি? আইন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা
আইন সম্পর্কে আরো জানতে বিডি ‘ল’ নিউজ এর সাথেই থাকুন ধন্যবাদ
Structure of Law Essays and RESEARCH REPORT OF LAW
Discussion about this post