চোখের সামনে মাকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখেছে সাড়ে ছয় বছরের শিশু মাহির আক্তার। কোমলমতি শিশুর এই চাক্ষুস অভিজ্ঞতা হয়তো সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। তবে মনোচিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে।
পুলিশ সুপার বাবুল অাক্তারের ছেলে মাহি। গত ৫ জুন মা মাহমুদা খানম মিতুকে এই শিশুটির সামনেই খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। সেই দৃশ্য ভুলতে পারছে না শিশুটি। অাতঙ্ক আর মা হারানোর মানসিক হাহাকারের মধ্যে থাকা ছোট্ট মাহিরকে এখন শোক ভুলিয়ে ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে একজন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে কাউন্সিলিংও করানো হয়েছে মাহিরকে। দুঃসহ সেই স্মৃতি ভোলাতে মাহিরের খালা, নানীসহ পরিবারের লোকজন সঙ্গ দিচ্ছেন। বিশেষ করে তাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে ঘুমানো ও অাড্ডা-খেলাধুলায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে আছেন বাবা বাবুল অাক্তার। খেলার সাথী তারই আড়াই বছরের বোন তাবাস্সুম।
গত রোববার থেকে ভাই-বোন দুজনেই মাকে সারাক্ষণ খুঁজছিল। তবে এখন ধীরে ধীরে সেই অস্থিরতা কমছে। তাদের মায়ের শূন্যতা ভুলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। নানা খেলনা সামগ্রীর পাশাপাশি দুটি খরগোশের বাচ্চাও আনা হয়েছে মাহির ও তাবাস্সুমের জন্য। যতক্ষণ জেগে থাকছে ততক্ষণ সার্বক্ষণিক কাছে কাছে থাকছেন আপনজনদের কেউ না কেউ।
এভাবে দিন কাটছে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে বাসার অদূরে দুর্বৃত্তের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া মাহমুদা খানম মিতুর সাড়ে ছয় বছর বয়সী পুত্র মাহির আক্তার ও আড়াই বছর বয়সী মেয়ে তাবাস্সুমের। হত্যাকাণ্ডের পরদিন থেকে তাদের নিয়ে ঢাকার বনশ্রীতে শ্বশুরবাড়ি থাকছেন বাবুল অাক্তার। তিনিও শোক কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছেন। তবে চাকরিতে যোগদানের চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত সব মনযোগ মা হারা তার সন্তানদের দিকে।
তবে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, তাবাস্সুম বয়স কম হওয়ায় তেমন সমস্যা না হলেও আজীবনই ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে মাহিরকে। এই শিশুটি সারাজীবন অনিরাপত্তা বোধ নিয়ে বেড়ে উঠবে এবং এক প্রকার অজানা ভয় তাকে সবকিছুর প্রতি অবিশ্বাসী করে তুলবে।
আবার যদি তার মধ্যে একপ্রকার প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব গড়ে ওঠে তাহলে সেটি তার জন্য আরো খারাপ হবে। সব মিলিয়ে তার স্বাভাবিক ঘুম, আহার ও বেড়ে ওঠায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেজন্য তাকে এই হত্যাকাণ্ডের সব কথা একেবারেই ভুলিয়ে রাখার পাশাপাশি তদন্তের স্বার্থেও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করার পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সব মিলিয়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে মাহিরকে লালন পালন করার কথা বলেছেন তারা।
মাহিরের নানার বাড়ি সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন ঘুমোতে নেয়া, ঘুম পাড়ানো, সকালে ঘুম থেকে উঠানো থেকে শুরু করে দাঁত ব্রাশ, গোসল ও সকালের নাস্তা করানো এবং ভাত খাওয়ানোর কাজটি করছেন বাবা বাবুল আক্তার। এরপর দেখতে আসা স্বজন শুভ্যার্থীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে দিলেও তাদেরকে পুরোপুরি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় খেলাধুলায় মগ্ন রাখা হচ্ছে। তাদের পাশে সার্বক্ষণিক নিকটাত্মীয়রা থাকছেন, সঙ্গ দিচ্ছেন। বাইরের অথিতিদের বিদায় দিয়ে নতুন কিনে আনা খরগোশের বাচ্চাগুলো নিয়ে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে খেলতে বসছেন বাবুল আক্তার।
এমনকি মাঝে মধ্যে বাড়ির ছাদে, ঢাকার ভেতর নিকটাত্মীয়ের বাসায় মাহির ও তাবাস্সুমকে বেড়াতেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে গত মঙ্গলবার থেকে পাওয়া খরগোশ দুটি পেয়ে কিছুটা খেলাধুলায় মনযোগী হয়েছে তারা। এরপরও বিছানায় ঘুমোতে গেলে কিংবা খেতে গিয়ে তারা দুজনেই মায়ের কথা জিজ্ঞেস করছে।
তাবাস্সুম এখনো পুরোপুরি তার মায়ের মারা যাওয়ার কথাটি বুঝতে না পারলেও মাহির বারবারই তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে মাকে খুঁজছে। এসময় অন্যদেরও অাবেগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
মূলত এভাবেই গত ছয় দিন ধরে চলছে মাহীন মাহির ও তাবাস্সুমের দিনকাল। একইভাবে দিন কাটছে প্রিয়তমাকে হারানো আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল অাক্তারের মিতুবিহীন নিঃসঙ্গ দিনরাত্রি।
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার বলেন, ‘মা হারা দুই সন্তানকে নিয়েই এখন আমার পুরো দিনরাত কাটছে। এখন আমিই তাদের মা, আমিই তাদের বাবা। আগের চেয়ে দুজনেরই মনের অবস্থা স্বাভাবিক হলেও দিনে বেশ কয়েকবার তারা মাকে খুঁজছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সব ভুলিয়ে রাখতে দিনভর খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখার পাশাপাশি তাদের কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তারা দুজনেই দুটি খরগোশের বাচ্চা পেয়ে এগুলোর সঙ্গে খেলা করছে। ইতোমধ্যে মাহিরকে একজন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে কাউন্সেলিং করা হয়েছে।’
এসময় হত্যাকাণ্ডের পর মাহিরের কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চাওয়া কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর কড়া সমালোচনা করেন বাবুল অাক্তার। তিনি তাদের মানবিক ও পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও প্রশ্ন রাখেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ সাজ্জাদ কবির বলেন, ‘এধরনের শিশুরা এক ধরনের অনিরাপদবোধের মধ্য বেড়ে উঠবে। অজানা এক ভয় সারাক্ষণ কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে। ঘুমোতে গেলেও তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে তার সামনে নির্মমভাবে হত্যার দৃশ্যটি। সারাজীবন একটা ট্রমা নিয়ে বেড়ে উঠবে মাহির। তার মনে আসবে, মানুষের জীবন এত মূল্যহীন? প্রকাশ্যে খুনিরা তার মাকে তার সামনে খুন করে চলে গেলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে সে বড় হওয়া পর্যন্ত অবিশ্বাসের মধ্যে থাকবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে শিশুটিকে এই ঘটনা থেকে বের করতে পারিবারিক সহায়তা সবচেয়ে বেশি দরকার। পরিবারে পিতা, খালা কিংবা নানীসহ যারা খুব নিকটজন থাকে তাদেরকেই মাহিরকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিতে হবে। এছাড়া তার প্রফেশনাল কাউন্সেলিংও খুব প্রয়োজন।’
কোনওভাবেই এ হত্যাকাণ্ড তদন্তে মাহিরের জবানবন্দি সরাসরি নেয়া কিংবা তাকে পুনরায় ঘটনাস্থলে না নেয়ার পরামর্শ দেন এ মনোবিজ্ঞানী।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনার পর মাহিরকে যারা বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তারা মোটেই উচিত কাজ করেনি। এর ফলে তাকে বারবার ওই ঘটনার মধ্যে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোনও কাজই হয় না। ফলে মাহিররা এই সমাজের প্রতি কী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হবে তা বিবেচনায় নেয়া উচিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাহিরের মাথা থেকে তার মাকে হত্যার দৃশ্যপটটি চিরতরে মুছে দিতে হবে। ইমেজগুলো সরে যাওয়া কঠিন। তার সামনে এসব কোনও অালোচনা করা যাবে না। এখন থেকেই তার চারপাশের মানুষদের সতর্ক আচরণ করতে হবে। সে যেন প্রতিশোধপরায়ণ চিন্তার মধ্যে না ঢোকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
উল্লেখ্য, গত ৫ জুন রোববার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে মোটর সাইকেলে এসে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয় মাহিরের মা পুলিশ সুপার বাবুল অাক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে। এসময় মাহির তার মায়ের হাত ধরে হেঁটে স্কুল বাসে উঠার জন্য জিইসি মোড়ে যাচ্ছিল। ওই সময়ই নির্মমভাবে খুন হন মিতু। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহিরের স্কুলজুতোয় মায়ের রক্তের দাগ লাগে। এমনকি তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদটি মাহিরই তাদের ভবনের দারোয়ানকে প্রথম জানিয়েছিল।সুত্র বাংলামেইল
Discussion about this post