ব্যারিস্টার তাসমিয়া আনজুম
বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, দেনমোহর, যৌতুক এই সকল বিষয়ে আইন সংকান্ত জ্ঞান এর অভাবে প্রতি নিয়ত নানাধরনের আইনগত আধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের অসংখ্য নারী।
প্রথমেই যদি আমরা বিবাহ বিষয়ক আইনগত আলোচনায় আসি,তা হলে বলতে হয়, বিবাহ মানুষের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়, এটি একটি সামাজিক চুক্তি যার মাধ্যমে দুইটি মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ সংকান্ত আইন আছে যা কিনা মূলত সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন।এই আইন অনুযায়ী প্রতিটি বিবাহ সরকার নির্ধারীত কাজী দ্বারা রেজিষ্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ন কারন রেজিস্ট্রেশন ব্যতিত বিবাহ প্রমাণ করা কঠিন ফলে মেয়েদের প্রতারিত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় সবচেয়ে বেশী। রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিয়েতে নারীর অধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হয়। সামাজিকভাবেও তারা সবার কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে থাকে।
বিবাহ রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে সরকারিভাবে বিবাহ সম্পর্কিত অত্যাবশ্যক তথ্যবলী সরকারী রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করা। সরকারের নির্ধারিত ফরমে বিবাহের তথ্যবলী দিয়ে এই তালিকাভূক্তি করতে হয়। মুসলিম পরিবারিক আইনে বিবাহের রেজিস্ট্রেশন একটি প্রামান্য দলিল হিসাবে কাজ করে। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করার জন্য আমাদের দেশে আইন আছে, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন ১৯৭৪।পরবর্তী্তেন ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন কে সংশোধিত করা হয় ৮ই মার্চ, ২০০৫ সালে, এই আইন আনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং উক্ত সংশোধনীতে আরও বলা হয়েছে, নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী বিবাহ সম্পন্ন হবার সাথে সাথেই বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করবেন অথবা তিনি ব্যতিত অন্য কেহ বিবাহ সম্পন্ন করলে ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজীর নিকট বিবাহের তথ্য প্রদান করতে হবে এবং কাজী উক্ত তথ্য প্রাপ্তির সাথে সাথে বিবাহ রেজিস্ট্রি করবেন। যদি কেউ এই নিয়ম পালন না করে তবে সে দুই বছরের কারাদন্ড বা ৩০০০ (তিন হাজার) টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে। আইন অনুযায়ী কেউ যদি রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন তবে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। উল্লেখ যে, রেজিস্ট্রেশন না হলে বিবাহ বাতিল হয় না, তবে আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভবনা থাকে।
বিবাহ রেজিস্ট্রি করতে রেজিস্ট্রেশন সরকারি ফি দিতে হয়। রেজিষ্ট্রি ফি দেনমোহর টাকার উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের বিবাহ এবং তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা – ১৮ ধারাতে বর্ণিত হয়েছে “বিবাহ নিবন্ধন ফি বাবদ একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার দেনমোহর প্রতি ১০০০/- (এক হাজার টাকা) বা উহার অংশ বিশেষের জন্য ১০/- (দশ টাকা) হারে সর্বনিম্ন ১০০/- (একশত) এবং সর্বোচ্চ ৪০০০/- (চার হাজার টাকা) আদায় করিতে পারিবেন।
১৯৭৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) বিধিমালাতে রেজিস্ট্রি করার আগে, বিবাহের কাজী কে কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরপ করতে হবে, যেমন- বরের বয়স কমপক্ষে ২১ এবং কনের কমপক্ষে ১৮ বছর হয়েছে কিনা, বর ও কনের বিয়েতে পূর্ণ সম্মতি আছে কিনা, বিবাহের প্রকৃত সাক্ষী রয়েছে কিনা এবং বিয়েতে আশু ও বিলম্বিত দেনমোহর কত নির্ধারিত হয়েছে. বিয়েতে উল্লেখিত শর্তগুলো পূরণ হলেই কেবল কাজী (নিকাহ রেজিস্ট্রার) বিবাহ নিবন্ধন করবেন। তবে তিনি কাবিননামার ১৮ নম্বর ঘরে স্ত্রীকে তালাক প্রদানের (তালাক-ই-তৌফিজের) ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কিনা, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখবেন।
একজন বিবাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের জন্য, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯, এর অধীনে যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে – একটি বিবাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স প্রার্থীদের মাদ্রাসা বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলীম সার্টিফিকেট অর্জন করতে হবে এবং বয়স ২১ – ৪০ বছরের মধ্যে হতে হবে এবং একটি নির্ধারিত আবেদন পত্রে নির্ধারিত ফী সহ উপদেষ্টা কমিটি সচিবের বরাবরে আবেদন করতে হবে। উপদেষ্টা কমিটি বিবাহ রেজিস্ট্রার নির্বাচন করার বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করিবেন। উল্লেখ্য, একটি বিবাহ রেজিস্ট্রার এর সেবা একটি সরকারি সেবা নয়। একজন বিবাহ রেজিস্ট্রার ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই সেবা প্রদান করতে পারবেন।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন নারীদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন এর মাধ্যমে বর বা কনে পক্ষ উক্ত বিবাহ অস্বীকার করতে পারেন না এবং একে অপরের প্রতি সামাজিক ও পারিবারিক দায়-দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন।শুধু তাই নয়,বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা হলে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা এবং স্বামীর নিকট হতে দেনমোহর ও ভরনপোশন আদায় করা ও সম্ভব হয়,এ ছাড়া স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেন এবং স্বামী বা স্ত্রীর মৃর্ত্যুর পর একে অপরের বৈধ উত্তরাধিকার ও হতে পারেন বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা হলে।




Discussion about this post