
আর একদিন পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর আপিল মামলার।
তবে এ রায় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, এসব বক্তব্যের মাধ্যমে অতি উৎসাহীরা অপপ্রচার করছেন।
এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ এবং গণজাগরণ মঞ্চ, চট্টগ্রাম ফাঁসির রায় বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে। আর রায় ঘোষণার দিন পর্যন্ত রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান করবে গণজাগরণ মঞ্চ।
গত ৭ জুলাই এ আপিল মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায়ের জন্য বুধবার (২৯ জুলাই) দিন ধার্য রয়েছে। ৫ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত তিন কার্যদিবসে সাকা চৌধুরীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এসএম শাহজাহান। এর আগে প্রথমে আসামিপক্ষের শুনানিতে ১৬ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের রায়, সাক্ষীদের সাক্ষ্য-জেরা এবং রায় সংক্রান্ত নথিপত্র (পেপারবুক) উপস্থাপন করেন এসএম শাহজাহান।
অন্যদিকে গত ৩০ জুন এবং ১ ও ৭ জুলাই তিন কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে আপিল বিভাগে আসা পঞ্চম আপিল মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। গত ১৬ জুন সর্বশেষ চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় নিয়ে কোনো রকম ষড়যন্ত্র হলে সারা দেশে আগুন জ্বলবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার।
সাকা চৌধুরীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে চলমান গণঅবস্থান কর্মসূচিতে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। প্রতিকূল আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে এ গণঅবস্থান কর্মসূচি চলছে।
ইমরান এইচ সরকার বলেন, যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা। আমরা ইতোপূর্বেও দেখেছি, তিনি তার পারিবারিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নানাভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত ও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, শিশু রাজনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর কোনো মানবাধিকার সংগঠনকে দেখলাম না রাজনের জন্য বিচার চাইতে। অথচ তারাই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক রায় কার্যকর হলে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে খুনিদের বাঁচানোর চেষ্টা করে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তাদের কানে কি চট্টগ্রামের মানুষের কান্না পৌঁছে না? পৌঁছালে এখন তো তাদের একাত্তরের খুনি সাকার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাজপথে থাকার কথা।
আগামী ২৯ জুলাই আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার দিন পর্যন্ত গণজাগরণ মঞ্চ রাজপথে থাকবে বলে ইমরান জানান।
এদিকে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রতি আহবান জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ, চট্টগ্রামও।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে গণজাগরণ মঞ্চ, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. চন্দন দাশ এবং সমন্বয়কারী শরীফ চৌহান এ আহবান জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হয়েছিল। একাত্তরে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মুক্তিকামী বাঙালি, মুক্তিযোদ্ধা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা-নির্যাতনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালে রায়ে সেটা প্রমাণিতও হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে বলেই রায়ে তার ফাঁসি হয়েছে।
‘আমরা ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায় আপিল বিভাগেও বহাল রাখার দাবি জানাচ্ছি। আত্মস্বীকৃত, কুখ্যাত এই নরপশুর ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো রায় চট্টগ্রামের মানুষ মেনে নেবেন না’- বলেন দুই সংগঠক, যারা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পর চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা এবং এই জনপদেই একাত্তরে নৃশংস কর্মকাণ্ডের হোতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় ঘোষিত হবে ২৯ জুলাই। তবে এর আগেই সংবাপত্রে প্রকাশিত কিছু তথ্য নিয়ে রায় সম্পর্কে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
তারা বলেন, আমরা সংশ্লিষ্টদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আরেক যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় মানতে না পারায় ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে লাখো-কোটি জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল। চট্টগ্রামবাসীসহ বাংলাদেশের মানুষ আবারও অধীর আগ্রহে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় দেখার অপেক্ষায় আছেন। আমরা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে তার ফাঁসির রায় বহাল রেখে শহীদদের আত্মাকে শান্তি দেওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য আপিল বিভাগের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই বছরের ২৯ অক্টোবর খালাস চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন তিনি। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।
ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ১৭টির পক্ষে সাক্ষী হাজির করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এগুলোর মধ্যে মোট ৯টি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকি আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেননি সেগুলো থেকেও সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে চারটিতে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাকা চৌধুরীকে। তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দু’টি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে। সব মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৭০ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি।
যে চারটি হত্যা-গণহত্যার দায়ে সাকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো ৩ নম্বর (অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা), ৫ নম্বর (রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে গণহত্যা), ৬ নম্বর (রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০-৫৫ জনকে গণহত্যা) এবং ৮ নম্বর (চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যা) অভিযোগে।
অন্যদিকে ২ নম্বর (রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা), ৪ নম্বর (জগৎমল্লপাড়ায় ৩২ জনকে গণহত্যা) এবং ৭ নম্বর অভিযোগে (রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যা) আনা তিন হত্যা-গণহত্যায় সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
১৭ এবং ১৮ নম্বর অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে আরও পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যে দু’টি অভিযোগে যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে নির্যাতন এবং চান্দগাঁওয়ের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সাকা চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
Discussion about this post