নিজস্ব প্রতিবেদক: পাঁচ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের নৃশংস ঘটনায় দেশজুড়ে নাড়া দিয়েছিলো। এদের সাত জনকেই হত্যা করা হয়েছিলো অভিনব স্টাইলে। হত্যা করার পর নদীতে ফেলে দিয়ে মরদেহ যেন ভেসে উঠতে না পারে সেজন্য প্রত্যেকটি লাশের মুখে ডাবল পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়।সেই নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের পাঁচ বছর আজ শনিবার। এই মামলার বিচারকাজ দুইটি আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন আপিল ডিভিশনে তৃতীয় পর্যায়ে আইনি প্রক্রিয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। মামলার রায় কার্যকরে ধীরগতি হওয়ার কারণে মামলার আইনজীবী, নিহতের স্বজনরা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। দ্রুত রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ১২৭ সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর হত্যায় জড়িত ২১ আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করে আদালত। আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ওঠে আসে সাত খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা।
মামলার নথি, চার্জশিট, জবানবন্দি ও সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণ করতে দিনক্ষণ আগে ঠিক করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল একটি চাঁদাবাজির মামলায় স্থায়ী জামিন নেয়ার জন্য নজরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ আদালতে আসবে। বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই সেদিন সকালে মেজর (অব.) আরিফ হোসেন অপহরণ পার্টিকে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এছাড়া সাদা পোশাকের একটি টিম আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান করে।
দুপুরে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পাওয়ার পর আদালত থেকে নজরুল ইসলাম বের হওয়ার সাথে সাথেই মেজর আরিফকে জানিয়ে দেয় সাদা পোশাকের র্যাব সদস্যরা। নজরুলের সাথে গাড়িতে ছিল সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন ও ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম। এই সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর। তাদের গাড়ির পেছনের গাড়ি ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের। নজরুলদের গাড়িটি ফতুল্লার খানসাহেব স্টেডিয়ামের কাছে লিঙ্ক রোডে পৌঁছলে মেজর আরিফের নেতৃত্বে দুইটি গাড়ি থেকে সাতজনকে অস্ত্রের মুখে র্যাবের দু্ইটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
এরপর প্রত্যেকের শরীরে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করে তাদের গাড়িতে রাখার পর নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীতে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাউন্সিলর নূর হোসেনকে ফোন দেয় আরিফ হোসেন। পরে গাড়ির মধ্যেই অচেতন অবস্থায় প্রত্যেকের মাথা ও মুখমণ্ডল পলিথিন দিয়ে মোড়ানোর পর গলা চেপে মারা হয় সাতজনকে। এরপর হাত পেছন করে রশি দিয়ে বেঁধে সাতজনের পায়ে ২৪টি করে ইটবোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ বাঁধা হয়। এরপর প্রত্যেকের পেট ছিদ্র করে ট্রলারে করে মেঘনা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার মোহনায় ডুবিয়ে দেয়া হয়।পরে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়ার শান্তিনগর এলাকা সংলগ্ন নদীতে কয়েকটি মরদেহ ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দেয় স্থানীয়রা। এরপর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে ছয়টি লাশ উদ্ধার করে। পরে ১ মে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
পরে এই ঘটনায় ফতুল্লা থানায় আলাদা করে দুইটি মামলা করে নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা ডা. বিজয় কুমার।
এই মামলার দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিচারকাজ সম্পন্ন করার পর নারায়ণগঞ্জ জজ আদালত তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও কমান্ডার এম এম রানা এবং নূর হোসেনসহ ২৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন।এই আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করে। এতে এই চারজনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে একই ধরনের আদেশ বহাল থাক। এই মামলার বাকি ১১ জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয় আদালত। বর্তমানে এই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আছে।
নূর হোসেন ও আওয়ামী লীগের আরেক নেতা নজরুল ইসলামের বিরোধের কারণে এই সাত খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণ করতে পেরেছে আদালত। র্যাব সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করেছে নূর হোসেন।
চাঞ্চল্যকর এই মামলার প্রধান আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, সাত খুন মামলার বিচারের রায় কার্যকর দেখার জন্য সারাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছে। এই মামলাটি একটি বীভৎস হত্যার ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যে এই হত্যকান্ড ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ সেই বিচারের রায় কার্যকর দেখতে চায়।
নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, আমি এই রায়টা নিয়ে খুবই আতঙ্কিত রয়েছি। আমরা সবাই আশা করে আছি কবে এই সাত খুনের বিচার হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার আশা, এই নরপিশাচদের এমন ভাবে সাজা দেয়া হোক, যাতে করে এমন অপরাধ আর কেউ করার সাহস না পায়। এই রায়টা যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়।




Discussion about this post