
গুরুত্বপূর্ণ এক মামলার রায় ইতিমধ্যে পনের মাস ধরে ফেলে রেখেছেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি অবসরে যান সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। সেই সময় তার হাতে ছিলো ২৫টি মামলার রায়। এর মধ্যে ২১ টির রায় তিনি জমা দিয়েছেন। ৪টি মামলার রায় তিনি এখনো লেখেননি। এর মধ্যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রায়টি তিনি ১৫ মাস ধরে ফেলে রেখেছেন। ওই রায় না লেখায় সাংবিধানিক পদধারীদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ক্রম বিন্যাস কিরূপ হবে তা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবসরের পর রায় লেখা যায় না। সর্বোচ্চ আদালতের রায় রয়েছে অবসরের পর একজন বিচারপতির লিখিত ও স্বাক্ষরিত রায় কোন রায় নয়। ভারত ও পাকিস্তানেও অবসরের পর রায় লেখা সমর্থন করা হয় না। সম্প্রতি রাষ্ট্র বনাম শাহিদুর রহমানের মামলায় বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা রায় দিয়েছেন ঘোষণার ৬ মাসের মধ্যে রায় লিখতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে রায় ভবিষ্যতে বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
সরকারের কার্যপ্রণালী বিধি (রুলস অব বিজিনেস) অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সরকার তা ২০০০ সালে আবার সংশোধন করে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের তত্কালীন মহাসচিব জজ মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিট আবেদনে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। রিট দায়েরের ১০ বছরেও গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটির নিষ্পত্তি হয়নি। রায় প্রকাশ না হওয়ায় এটি ঝুলে রয়েছে।
২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সরকারের প্রণীত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বাতিল ঘোষণা করে আট দফা নির্দেশনা দেয়। হাইকোর্টের ওই নির্দেশনায় বলা হয়, নতুন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের প্রথমেই সব সাংবিধানিক পদ গুরুত্ব অনুসারে রাখতে হবে। এরপর থাকবে সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদ। আদালত বলেছেন, জেলা জজদের পদ সংবিধানে উল্লিখিত পদ হওয়ায় সাংবিধানিক পদগুলোর পর পরই তাঁর অবস্থান হবে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, মুখ্য বিচারিক হাকিম ও মুখ্য মহানগর হাকিমদের পরের ক্রমিকে থাকবেন তিন বাহিনীর প্রধানেরা। আর সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের অবস্থান হবে তিন বাহিনীর প্রধানদের পরে। একইসঙ্গে আদালত জেলা জজদের রাষ্ট্রাচার (প্রটোকল) প্রদানেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিলো, নতুন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের প্রথমেই সব সাংবিধানিক পদ গুরুত্ব অনুসারে রাখতে হবে। এরপর থাকবে সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদ। আদালত বলেছেন, জেলা জজদের পদ সংবিধানে উল্লিখিত পদ হওয়ায় সাংবিধানিক পদগুলোর পর পরই তাঁর অবস্থান হবে। সংবিধানে প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, জেলা জজ বলতে অতিরিক্ত জেলা জজকেও বোঝায়। তাই অতিরিক্ত জেলা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের জেলা জজদের পর পরই রাখতে হবে।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। দীর্ঘ ৫ বছর পরে থাকার পর ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের ওই আদেশ পুরোপুরি গ্রহণ না করে কিছু সংশোধন করা হবে বলে অভিমত দেয়। সরকার ওই রায় পুন:বির্বেচনার আবেদন জানায়। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ সংযোজন, সংশোধন, পর্যবেক্ষণ ও অভিমতসহ আপিল নিষ্পত্তির করা হয়েছে মর্মে আদেশ দেয়।
আপিল বিভাগের পক্ষে রায় লেখার দায়িত্ব পান তত্কালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। তিনি ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার সময় তার হাতে ছিলো ২৫টি মামলার রায় লেখার দায়িত্ব। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত তিনি ২১টি মামলার রায় লিখে জমা দিয়েছেন। তার হাতে ৪টি মামলার রায় এখনো রয়ে গেছে। এর মধ্যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে রায়টি তিনি ১৫ মাস ধরে ফেলে রেখেছেন। এই মামলার বিষয়বস্তুর সঙ্গে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মরতদের স্বার্থ রয়েছে। এই রায় প্রকাশ হলে সরকারের করা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বাতিল হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আপিল বিভাগ যে রায় দিবে তার উপর ভিত্তি করে নতুন করে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরী করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার রায় ১৫ মাস ধরে ফেলে রাখায় আইন বিশেষজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এমনিতেই এই রায় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাছাড়া অবসরের পর এই রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
প্রচলিত কোন আইন বা ভিন্ন দেশের নজির অবসরের পর রায় লেখা সমর্থন করে না। ভারতসহ বেশিরভাগ দেশেই বিচারকের সই হওয়ার পরেই লিখিত রায়ের কার্যকর অংশ প্রকাশ্য আদালতে পড়া হয়। জরুরি বিষয় হলে আদেশ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য আলাদা দিন ধার্য করা হয়। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের হাইকোর্ট রুলসেও এই বিধান আছে। দ্যা সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপিল বিভাগ) রুলস, ১৯৮৮ এর অর্ডার ১০ এর বিধিতে বলা আছে, “আদালত মামলার শুনানি শেষ করার পরে তাত্ক্ষনিকভাবে কিংবা ভবিষ্যতে কোনদিনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে বা তাদের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডকে নোটিশ দিয়ে রায় ঘোষণা করবেন।” আপিল বিভাগের রুলসের ২৬ নম্বর বিধিতে উল্লেখ রয়েছে, “কেবল রিভিউ সাপেক্ষে রায় নড়চড় হতে পারে। এই উপায় ছাড়া রায় প্রদানকারী আদালত বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক বা কোন ভিন্নমত প্রদানকারী বিচারক তাদের দ্বারা ঘোষিত রায়ের কোন পরিবর্তন বা সংয়োজন করতে পারবেন না। ওই রায়ের আদেশের অংশ প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে সংযোজন, সংশোধন, পর্যবেক্ষণ ও অভিমতসহ আপিল নিষ্পত্তি করা হলো। ফলে কি পরিবর্তন ও সংশোধন হলো তা প্রকাশ্য আদালতের মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়নি।এসব কারণে এই রায় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির শংকা রয়েছে।
অবসরের পর রায় লেখা যায় না
অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে দেশে একটি সাংবিধানিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেছেন, অবসরের পর রায় লেখা সংবিধান সম্মত নয়। তিনি আরো বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানে অবসরের পর রায় লেখা যায় না। সাংবিধানিক পদাধিকারীদের নিয়োগ কার্যকর হয় শপথ গ্রহনের মধ্য দিয়ে এবং পদত্যাগ ও অবসরের মধ্য দিয়ে তাদের নিয়োগের অবসান ঘটে। এ কারনে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবসরের পরে রায় লেখা সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। কেননা অবসরের পর বিচারপতির শপথ বহাল থাকে না এবং তিনি একজন সাধারণ নাগরিকে পরিণত হন।
অবসরের পর রায় লেখা যায় কিনা ৫২ বছর আগে কাজী মেহারদিন বনাম মুরাদ বেগম মামলায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছিলো। হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক অবসরের পর একটি রায় লেখেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে সুপ্রিম কোর্টের তত্কালীন প্রধান বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বে পাঁচজন বিচারক একটি রায় দেন। রায়ে বলা হয়, অবসর পরবর্তী সময়ে একজন বিচারপতির লিখিত ও স্বাক্ষরকৃত রায় কোন রায় নয়। এই রায় এখনো বলবত রয়েছে। কেননা অন্য কোন রায় দ্বারা এই রায় এখনো উল্টায়নি। ভারত, পাকিস্তানেও অবসরের পর রায় লেখা যায় না।




Discussion about this post