সাইফুল, পটিয়া প্রতিনিধি, বিডি ল নিউজঃ
চট্টগ্রামের পটিয়ায় একাত্তরে পাক সেনাদের বর্বর নির্যাতনের শিকার আছিয়া বেগম পঙ্গুত্ব জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছে। বিগত ৪৪ বছরে তার আত্মত্যাগের কোন স্বীকৃতি যেমন সে পায়নি, তেমনি তার সহায়তায়ও কেউ এগিয়ে আসেনি। বর্তমানে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলছে তার গন্তব্যহীন জীবন। তার অপরাধ ছিল তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে সংগ্রাম কমিটিকে এলাকায় পাক বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আলবদরদের নানা তথ্য সরবরাহ করতেন। এমনকি সত্তরের নির্বাচনে তিনি আ’লীগ দলীয় প্রার্থীর এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় একাত্তরের ১৬ই এপ্রিল অন্যান্যদের সাথে একমাত্র নারী হিসেবে তাকে সেদিন রাষ্ট্রদ্রোহীতা মামলার আসামী করা হয়। তার জীবনে ১৯৭১ সালের ১ জুন স্মরণীয় কালো রাত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেদিন পাক বাহিনী তার কচুয়াইস্থ বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে খোঁজ করে। তিনি সেখান থেকে আত্মগোপন করেন। কিন্তু পাক সেনারা যখন অস্ত্র তাক করে তার পিতাকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়, তখন সে তার পিতাকে বাঁচাতে অস্ত্রের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে সময়ে পাক সেনারা তাকে অস্ত্রের বাট দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। পরে সে আঘাতে তিনি চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
গতকাল তার সাথে আলাপকালে বিডিলনিউজকে স্মৃতি হাতড়িয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর যখন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়, তখন আমি পটিয়া কলেজের ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ছিলাম। সে সময়ে আমি পটিয়া ও কলেজ সংগ্রাম কমিটির মহিলা সম্পাদিকার দায়িত্ব পাই। আমার শিক্ষক রনজিত কানুনগো, আবদুর রশিদ মাস্টার, চিত্তরঞ্জন সেন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমি মেজর খালেদ সিরাজুল ইসলাম খালেদ, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, হামিদুর রহমান অধ্যক্ষ নুর মোহাম্মদ, অধ্যাপক ফজলুল করিম চৌধুরী, আবু ছালেহ, কমরেড শাহ আলম ও ফনী ভূষণ দাশের সাথে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করি।
সত্তরের নির্বাচনে আ’লীগ প্রার্থীর পক্ষে আমি এজেন্টের দায়িত্ব পালন করি। ১৬ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে কচুয়াই ইউনিয়ন শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান আহমদ কবির আ’লীগের ৩৬ জন নেতৃবৃন্দকে আসামী করে পাকিস্তানের বিপক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে। সেখানে আমি একমাত্র মহিলা আসামী ছিলাম। আসামীর কলামে আমার নাম ছিল ২৫ নাম্বারে। উকিল সুখেন্দু গুহের স্ত্রী-কন্যাকে আমার পরিবারে আশ্রয় দেওয়া, রাজাকারের ধাওয়া হতে মিলন সরকারকে লুকিয়ে রাখা, গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খবরা-খবর দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধারা রাতে আসলে খাবার দেওয়া, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা মতিলাল দাশ, সিরাজুল ইসলাম খালেদ, নুরুল আলম আরো অনেককেই আমি সেদিন সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছি বলে একের পর এক আমার উপর নানা নির্যাতন নেমে আসে। আমি যুদ্ধে ভারত চলে যেতে চাইলে আমার বোনপো মেজর খালেদ রাজি হননি। তিনি বলেন, আপনাকে দেশের বিভিন্ন তথ্যের জন্য এখানে অবস্থান করতে হবে। মতিলাল আমাকে একদিন বলেন, শান্তি বাহিনীর লোকজন তোমার কার্যকলাপে সন্দিহান। আঁচ করছি, তোমার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা। তুমি কিছুদিন বাড়ি থেকে সরে যাও। তখন বাহুলী নিবাসী মাওলানা নুরুল হক সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। মাওলানার বিধবা স্ত্রী সম্পর্কে আমার ফুফু হয়। সেখানে কিছুদিন থেকে আমার বৃদ্ধা ফুফুসহ আমাদের আসার ৩/৪ ঘন্টা পর আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ৩০/৪০ জন পাক বাহিনীর সদস্য ও তাদের সহযোগী রাজাকার শান্তি বাহিনী মিলে আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। তখন সাঝের মায়া বিচ্ছুরিত হয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছিল। আমি ও ফুফু আমার পড়ার ঘরে একই জায় নামাজে মাগরিবের নামাজ শেষ করে আল্লাহকে বিশেষভাবে স্মরণ করছিলাম। বাহিরের খবর জানতাম না। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে দেখতে পাই, সিভিল পোশাকে কে যেন নামাজ শেষ করার অপেক্ষায় আছে। জায় নামাজ থেকে উঠার সাথে সাথে দুইজন লোক ঘরে ঢুকে টেবিলের উপর হতে হারিকেন নিয়ে আমাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন ‘তুম আছিয়া হে’? আমার নাম অস্বীকার করলে দ্রুত তারা কক্ষ ত্যাগ করে। পরে বাবার কাছে আমার খোঁজ করে। আমি পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেনকে বুঝতে বাকি নেই। হাতে ছিল বন্ধুক। তড়িৎ বেগে ঘর হতে বের হয়ে বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করি। ঘন্টারও বেশি সময় আমাকে খুঁজেছে তারা। না পেয়ে তারা আমার বাবাকে অমানসিক নির্যাতন শুরু করে। এমনকি বাবাকে প্রাণে হত্যা করার জন্য যখন অস্ত্র তাক করে, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আমি বিদ্যুৎ বেগে বাবার প্রাণ রক্ষার্থে তাদের অস্ত্রের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন বলি আমার বাবাকে নয়, আমাকে হত্যা কর। আমার বাবাকে ছেড়ে দাও। তখন ক্যাপ্টেন বাবার হাত থেকে হারিকেনের বাতি নিয়ে আমাকে আবার দেখে বলল, ‘তুম জুট বাত হে’। হ্যাঁ নাম অস্বীকার করেছিলাম। তখনই রাইফেলের বার দিয়ে প্রচন্ডভাবে আমাকে আঘাত করে মুমুর্ষ করে ফেলে তারা। তারপর বলে ক্যাম্পে যেতে হবে। বাবা বললেন, এখানে গুলি করেন। ক্যাম্পে যাবে না। আমার মেয়ে মুমূর্ষ। ক্যাপ্টেন নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে বোরকা ও কোরান শরীফ নিই। মৃত্যু আমার নিশ্চিত, তাই মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকলাম। পরে পাকসেনারা বাবাসহ আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেই স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই থেকে আজ অবদি দু’চোখের পাতাকে এক করতে পারিনি। তবে থেমে থাকেনি আমার পথ চলা। আমি পটিয়া কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেখান থেকে এম এ ডিগ্রি গ্রহণ করি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এড ডিগ্রি সহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। কিন্তু বিগত ৪৪ বছরে কেউ আমার এই কষ্টের ও ত্যাগের মুহুর্তগুলো শেয়ার করতে আসেনি। তাই সেদিনের সেই স্মৃতি মনে হলে নিজেকে কোন উত্তর দিতে পারিনা। যে দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলাম দেশ স্বাধীনের ৪৪ বছর পার হলেও আমাদের মত নির্যাতিতদের স্বীকৃতি যেমন কেউ দেয়নি, তেমনি আমাদের পাশেও দাঁড়ায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ দেশে পাকিস্তানিরা সেদিন আমার মত লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করেছে। অথচ এখনো সেই পাকিস্তানিদের স্বপক্ষে মহল বিশেষ যখন কথা বলে তখন প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাই না। তবে তাদেরকে থুথু দিয়ে ধিক্কার জানাই। যতদিন বেঁচে থাকব, এ কাজটি শুধু করে যাব এবং এ দেশের বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার শুরু হয়েছে সেটা যেন বন্ধ না হয়, সে দোয়াই করে যাব। পটিয়া উপজেলার সহকারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (ত্রাণ-পুনর্বাসন ও যুদ্ধাহত বিষয়ক) যুগল সরকার বলেন, আছিয়া বেগমের আত্মত্যাগের মূল্য বিগত ৪৪ বছরেও কেউ দেয়নি। তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করা গেলে তাদের আত্মত্যাগ ব্যর্থতায় পর্যবেক্ষিত হবে না। বরংচ তারাও সেদিন দেশ স্বাধীনের জন্য ভূমিকা রাখায় মুক্তিযোদ্ধাদের মত নিজেদেরকে ধন্য মনে করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানাচ্ছি।
Discussion about this post