মৃত্যুকালীন ঘোষণা বা dying declaration হলো আদালত প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত একটি পরিভাষা যা সাক্ষ্য আইনের ৩২নং ধারার (১) উপধারা বলে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়। এছাড়াও পুলিশ রেগুলেশন অফ বেঙ্গলের (PRB) ২৬৬নং বিধিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সাধারণভাবে ব্যক্তির দেয়া মৌখিক সাক্ষ্য সেই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য নয়। মৃত্যুকালীন ঘোষণা সেক্ষেত্রে একটি বিশেষ ব্যতিক্রম।
★ যেভাবে সূত্রপাত ঘটেঃ-
মধ্যযুগীয় ইংলিশ কোর্টে ‘Nemo moriturus praesumitur mentiri’ নামক মূলনীতিটির সূত্রপাত ঘটে। যার অর্থ- ‘no-one on the point of death should be presumed to be lying’। ১২০২সালে একটি মামলায় সর্বপ্রথম dying declaration সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।
★ মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞাঃ-
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ৩২(১) ধারার আওতাভুক্ত বিবৃতিকে সাধারণত মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলা হয়৷
২০০৪ সালের একটি মামলায় High Court Division কর্তৃক মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কর্তৃক তার মৃত্যুর পূর্বে প্রদত্ত মৌখিক বা লিখিত বিবৃতি হচ্ছে মৃত্যুকালীন ঘোষণা [The state Vs Abdul Hatem 9 DLR (HC)(2004) 228 (231)]। এই ঘোষণা প্রশ্নের উত্তরে লিখিত হতে পারে / মৌখিক হতে পারে / চিহ্ন এবং অঙ্গভঙ্গির দ্বারাও হতে পারে।
মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নিন্মলিখিত উপাদানগুলো দেখা যায়; যথা-
• বিবৃতিদানকারী ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করতে হবে।
• উল্লিখিত বিবৃতিটি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে হতে হবে।
• উল্লিখিত অবস্থা বা ঘটনার ফলে তার মৃত্যু হতে হবে।
• বিবৃতিদানকারীর মৃত্যু বিচার্য বিষয় হতে হবে।
• বিবৃতিদানকারী বিবৃতি দেয়ার যোগ্য হতে হবে।
মূলত উপরোল্লিখিত ৫টি উপাদানের সমন্বয়েই মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞা গঠিত।
★ মৃত্যুকালীন ঘোষণা কার্যকর করার শর্তসমূহঃ-
এ ধরনের ঘোষণা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক; যথা-
• ভিকটিমের ঐ বিবৃতি প্রদান করার শারীরিক সক্ষমতা ছিলো কি না?
• সাক্ষীরা ঐ বিবৃতি সঠিকভাবে শুনেছে কি না? এবং আদালতে আঘাতদানকারীদের নাম সঠিকভাবে পুনঃস্থাপন করেছে কি না?
• মৃত্যুকালীন ঘোষণাকারীর সঠিকভাবে আঘাতদানকারীদের সনাক্ত করার সুযোগ ছিলো কি না?
★ সাক্ষ্য হিসেবে মৃত্যুকালীন ঘোষণার গ্রহণযোগ্যতাঃ-
আইন প্রণেতারা সাক্ষ্য হিসেবে মৃত্যুকালীন ঘোষণাকে গ্রহণযোগ্য করেছেন দুটি কারণে।
★মৃত্যুকালীন ঘোষণা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবলী এবং উত্তরঃ-
• প্রশ্নঃ- মৃত্যুকালীন ঘোষণাকারী বেঁচে গেলে ঘোষণার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে কি না?
• প্রশ্নঃ- পুলিশের নিকট প্রদত্ত মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণযোগ্য হবে কি না?
উঃ– মৃত্যু ঘোষণা পুলিশের নিকট প্রদান করা যায় এবং তা সাক্ষ্য হিসেবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, সাক্ষ্য আইনে মৃত্যুকালীন ঘোষণা পুলিশের নিকট প্রদান করা হলে তা অপ্রাসঙ্গিক হবে এরূপ বিধান উল্লেখ করা হয়নি। এর মানে হচ্ছে, যেকোন ব্যক্তির নিকট মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করা যাবে।
• প্রশ্নঃ- মৃত্যুকালীন ঘোষণা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করতে হবে কিনা?
উঃ– এই ধরনের ঘোষণা কাছাকাছি যেকোন ব্যক্তি কর্তৃক রেকর্ডকৃত হতে পারে। এমন কোন বিধান নেই যে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৬৪(৩) অনুসারে দোষস্বীকারমূলক বিবৃতির মতো মৃত্যুকালীন ঘোষণাও ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক রেকর্ডকৃত হতে হবে।
• প্রশ্নঃ- শুধুমাত্র মৃত্যুকালীন ঘোষণার উপর ভিত্তি করে দন্ড প্রদান করা যাবে কি না?
উঃ– আইনের এমন কোন বিধান বা নীতি নেই যে যদি মৃত্যুকালীন ঘোষণা সাধারণ সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হয়, তাহলে তার উপর ভিত্তি করে কোন দন্ড দেয়া যাবে না।
তবে [khushal Rao PLD 1958, Supreme court (Ind) 203] মামলায় বলা হয়েছে, সার্বিক দিক থেকে মৃত্যুকালীন ঘোষণা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং এর সত্যতা যাচাই করার পর আদালত যদি মনে করে যে মৃত্যুকালীন ঘোষণা ত্রুটিপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য নয় তখন স্বাধীন সমর্থনমূলক সাক্ষ্য ব্যতীত উক্ত মৃত্যুকালীন ঘোষণার উপর ভিত্তি করে দন্ড দেয়া যাবে না।
[Taj Mahmud 12 DLR (WP) Lahore 30] মামলায় বলা হয়েছে, যদি একটি মৃত্যুকালীন ঘোষণা খাঁটি এবং নির্ভূল বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে উক্ত মৃত্যুকালীন ঘোষণা স্বয়ং দন্ডের ভিত্তি হতে পারে। অর্থাৎ স্বাধীন বা স্বতন্ত্র সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হলেও এই ঘোষণার ভিত্তিতে দন্ড প্রদান করা যাবে, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ঘোষণাটি খাঁটি এবং নির্ভূল বলে প্রমাণ হতে হবে
• প্রশ্নঃ- আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির বর্ণনামতে দাখিলি এজাহারের বিবরণকে কি তার মৃত্যুর পর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করা যায়?
উঃ- (Rashid Ahmed vs State, 54 DLR 33) মামলার সিদ্ধান্তে আদালত এ সম্পর্কে বলেন, মৃত্যুর পূর্বে নিহিত ব্যক্তি নিজে এজাহার প্রদান করায় তার মৃত্যুর পর তা সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করা যায় এবং তার উপর নির্ভর করে আদালত আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে।
• প্রশ্নঃ- মৃত ব্যক্তির দাখিলি এজাহারে ঘাতক হিসেবে কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখ থাকলেও তার নাম মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে উল্লেখ করা না হলে তাকে কি দোষী সাব্যস্ত করা যায়?
উঃ– মৃত ব্যক্তির জবানবন্দির ভিত্তিতে লিপিবদ্ধ এজাহারে একজন ঘাতক হিসেবে উল্লেখ থাকলেও, তার নাম মৃত ব্যক্তির মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে উল্লেখ না থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তি যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের অবকাশে খালাস পেতে পারে। [Amjad hossen vs State, 1985 BLD (AD) 63]
• প্রশ্নঃ- শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণ সঠিক হবে কি না?
উঃ– (Shahbuddin vs State 61 DlR 54) মামলায় বলা হয়, আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুকালীন ঘোষণা দেয়ার সময় উপযুক্ত অবস্থায় ছিল এর সপক্ষে মেডিকেল সার্টিফিকেটের অনুপস্থিতিতে শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণ করা ঝুঁকিপূর্ণ।
• প্রশ্নঃ- হুবহু এবং একইরূপ হতে হবে কি না?
উঃ– মৃত্যুকালীন ঘোষণা হুবহু এবং একইরূপ হতে হবে এমন নয়। যদি মৃত্যুকালীন ঘোষণার অন্যান্য শর্তাবলী পূরণ হয় তাহলে উক্ত ঘোষণা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
Discussion about this post