সাধারণত প্রত্যেক খুনই অপরাধজনক নরহত্যা, তবে প্রত্যেক অপরাধজনক নরহত্যাই খুন নয়
মূলতঃ অপরাধজনক নরহত্যা একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ৷ আর খুন একটি নির্দিষ্টবাচক শব্দ। খুন(m) অপরাধজনক নরহত্যার(ch) একটি শ্রেণী মাত্র। আইন বহিভূতভাবে বা বেআইনিভাবে কাউকে হত্যা করলে সেটিকে অপরাধজনক নরহত্যা বলে এবং কতগুলো কারণ ও অবস্থার প্রেক্ষিতে অপরাধজনক নরহত্যা খুন বলে বিবেচিত হয়।
কাউকে হত্যা করলে সেটাই অপরাধজনক নরহত্যা বলে বিবেচিত হতে পারে৷ কিন্তু সেটাকে খুন হিসেবে গণ্য করতে হলে, ৩০০ ধারানুযায়ী অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য বা জ্ঞান থাকতে হবে কিংবা দন্ডবিধির ৩০০ধারার ৪টি ক্ষেত্রের যেকোন একটির আওতায় পড়তে হবে। আর, যদি কোন হত্যার ঘটনা সেই ৪টি ক্ষেত্রে না পড়ে, তবে সেটা নরহত্যা হতে পারে কিন্তু খুন হবে না। এছাড়াও ৩০০ধারায় ৫টি ব্যতিক্রম উল্লেখ রয়েছে। সেই ব্যতিক্রমগুলি কোন ঘটনায় বিদ্যমান থাকলে, তাহলেও সেই মনুষ্য হত্যাকে খুন(m)না বলে নরহত্যা(ch) বলতে হবে।

রাস্ট্র বনাম তৈয়ব আলী গং[7BLD(AD)265] মামলায় বর্ণনা করা হয়েছে, “সকল খুনে রয়েছে অপরাধজনক নরহত্যা, কিন্তু সকল অপরাধজনক নরহত্যা খুন নয়৷”
অতএব, উল্লিখিত আলোচনা থেকে এই কথাটি পরিষ্কার যে, খুন(m) হতে হলে প্রত্যেক অপরাধজনক নরহত্যাকেই(ch) ৩০০ ধারায় উল্লিখিত ৪টি ক্ষেত্রের যেকোনো একটির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। নতুবা সেটাকে খুনবলা যাবে না। অন্যদিকে, (খুন ব্যতীত) শুধুমাত্র অপরাধজনক নরহত্যা দায়ে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে, উক্ত ঘটনাকে ২৯৯ধারার সংজ্ঞার আওতায় পড়ার পাশাপাশি আবশ্যিকভাবে ৩০০ধারার ব্যতিক্রমের আওতায়ও পড়তে হবে৷
খুন ও অপরাধজনক নরহত্যার মধ্যে পার্থক্য
১. শাব্দিকঃ-
Culpable homicide শব্দদ্বয় মূলত latin শব্দ ‘culpabills’ অর্থ ‘worthy of blame’ এবং ‘homocidium’ থেকে এসেছে, homo অর্থ man এবং cidium অর্থ act of killing।
Murder শব্দটি proto-Indo-European শব্দ “mrtro” বা French শব্দ “murdre” থেকে এসেছে। যার অর্থ “to die”।
২. সংজ্ঞাঃ-
পরিকল্পনা ব্যতীত উদ্দেশ্যহীনভাবে কাউকে হত্যা করা হলে, তা অপরাধজনক নরহত্যা বলে গণ্য হবে।
উত্তেজনা বা প্ররোচনাব্যতীত পরিকল্পিতভাবে কাউকে হত্যা করা হলে, তা খুন বলে গণ্য হবে।
৩. বিধানঃ-
দন্ডবিধির ২৯৯ ধারায় অপরাধজনক নরহত্যা সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে।
অপরদিকে, দন্ডবিধির ৩০০ ধারায় খুন সম্পর্কিত বিধান রয়েছে।
৪. Mens rea বা দুষ্টমনঃ-
অপরাধজনক নরহত্যার ক্ষেত্রে দুষ্টমন প্রমাণের দরকার নেই। পক্ষান্তরে, খুনের ক্ষেত্রে দুষ্টমন থাকা আবশ্যক।
৫. অভিপ্রায়ঃ-
বিচারপতি মেলভিল জে বলেন, খুনের ক্ষেত্রে সর্বদাই অভিপ্রায় থাকবে। তবে, অপরাধমূলক নরহত্যা যা খুন নয়, এমন অপরাধের ক্ষেত্রে অভিপ্রায় থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।
৬. আঘাতের পরিণামঃ-
বিচারপতি মেলভিল জে বলেন, ‘যেক্ষেত্রে নরহত্যার বা দৈহিক আঘাতের কোন অভিপ্রায় থাকেনা, এমন কোন কার্য করার ফলে যদি কোন ব্যক্তির মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে অপরাধটি কি অপরাধমূলক নরহত্যা নাকি খুন তা নির্ভর করে ঐ আঘাতের ফলে মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনার উপর। যদি ঐ আঘাতের সম্ভাব্য ফলাফল মৃত্যু হয়, তবে তা অপরাধমূলক নরহত্যা। অপরদিকে আঘাতের ফলাফল যদি নিশ্চিতভাবেই মৃত্যু হয়, তবে তা খুন বলে গণ্য হবে’
৭. অপরাধ সম্পর্কে জ্ঞানঃ-
বিচারপতি মেলভিল জে বলেন, “যদি অপরাধীর জানা থাকে যে, কোন ব্যক্তি বিশেষ কারণে বা অপ্রাপ্ত বয়সের ফলে কোন আঘাতে সে ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে, তবে অপরাধীর ঐ আঘাতের ফলে ঐ ব্যক্তির মৃত্যু হলে তা খুন বলে গণ্য হবে, যদিও ঐ আঘাত কোন সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট নয়।’
৮. প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মৃত্যুঃ-
বিচারপতি মেলভিল জে এ ব্যাপারে বলেন, ” যদি কোন আঘাত প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মৃত্যু ঘটানোর সম্ভাবনা থাকে এবং উক্ত আঘাতে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হয়, তবে তা অপরাধমূলক নরহত্যা যা খুন নয়। যদি কোন আঘাত প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে নিশ্চিতভাবেই মৃত্যু ঘটায় এবং উক্ত আঘাতে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হয়, তবে তা খুন। এটা নির্ভর করবে সম্ভাবনার মাত্রার উপর।”
৯. পূর্ব পরিকল্পনাঃ-
২৯৯ ধারায় হত্যার পূর্ব পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক নয়, কিন্তু ৩০০ ধারায় পূর্ব পরিকল্পনা একটি মূল উপাদান।
১০. নিষ্ঠুরতাঃ-
অপরাধজনক নরহত্যায় নিষ্ঠুরতা থাকলে, তা খুন হিসেবে গণ্য হয়। আর না থাকলে, তাকে শুধুমাত্র অপরাধজনক নরহত্যা হিসেবেই গণ্য করা যায়।
১১. মূল বা শাখা হিসেবে অবস্থানঃ-
অপরাধজনক নরহত্যা মূল অপরাধ। পক্ষান্তরে, খুন অপরাধজনক নরহত্যার একটি শাখা হিসেবে বিবেচিত হয়।
১২. একটির সাথে অপরটির সম্পর্কঃ-
সকল খুনই অপরাধজনক নরহত্যা, কিন্তু সকল অপরাধজনক নরহত্যাই খুন নয়।
১৩. অপরাধের প্রকৃতিঃ-
অপরাধজনক নরহত্যা খুন অপেক্ষা লঘুতর অপরাধ। অর্থাৎ খুন গুরুতর অপরাধ।
১৪. শাস্তির ধারাঃ-
খুনের শাস্তি বর্ণিত আছে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায়। অপরাধজনক নরহত্যা যা খুন নয়, তার শাস্তি বর্ণিত আছে ৩০৪ ধারায়।
- ১৫. শাস্তিঃ-
খুনের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড। অন্যদিকে, অপরাধজনক নরহত্যার শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ১০ বৎসর পর্যন্ত যেকোন বর্ণনার কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড।
১৬. খুন বা অপরাধজনক নরহত্যার চেষ্টাঃ-
খুনের চেষ্টার কথা দন্ডবিধির ৩০৭ধারায় বলা হয়েছে, শাস্তি- অনধিক ১০বৎসর কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড। চেষ্টার মাধ্যমে আহত করা হলে, আগের শাস্তির সাথে যাবজ্জীবন অন্তর্ভুক্ত হবে৷ অপরাধজনক নরহত্যার চেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা ৩০৮ ধারায় রয়েছে। শাস্তি- অনধিক ৩ বৎসর বা অর্থদন্ড বা উভয়। চেষ্টার মাধ্যমে আহত করা হলে, ৭ বৎসর বা অর্থদণ্ড বা উভয়।
১৭. উদাহরণঃ-
খুন- ‘ক’ কে হত্যার উদ্দেশ্য ‘খ’ গুলিবর্ষন কর, এতে ‘ক’ মারা যায়। ‘খ’ খুন করেছে।
অপরাধজনক নরহত্যা- ‘ক’ তার স্ত্রীর সাথে ‘গ’ কে যৌনকর্ম করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে ‘গ’ কে হত্যা করে। ‘ক’ অপরাধজনক নরহত্যা করেছে।
খুন ও অপরাধজনক নরহত্যা সম্পর্কিত আরো কিছু আলোচনা
২৯৯ ধারানুযায়ী অপরাধমূলক নরহত্যার উপাদানসমূহ-
• মৃত্যু ঘটানো।
• কোন কাজের দ্বারা (হতে পারে সেটা কোন দৈহিক জখম বা অন্যকোন কার্যের মাধ্যমে, যার সম্ভাব্য ফলাফল মৃত্যু)।
• মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়। (উদ্দেশ্য বা জ্ঞান ছিল উক্ত কাজের ফলে মৃত্যু ঘটবে)
২৯৯ধারার ব্যাখ্যাসমূহ-
ব্যাখ্যায় উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলিও অপরাধজনক নরহত্যা হিসেবে গণ্য হবে।
• কোন অসুস্থ ব্যক্তির উপর আঘাত করে, তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করলে।
• চিকিৎসা নিলে যে আঘাত ভালো হতে পারত বা ভালো হওয়ার সুযোগ ছিল, তেমন আঘাতে কারো মৃত্যু ঘটানো।
• মাতৃগর্ভে কোন শিশুর মৃত্যু ঘটানো অপরাধজনক নরহত্যা নয়, কিন্তু শিশু আংশিকভাবে জীবন্ত ভূমিষ্ট হওয়ার পর মৃত্যু ঘটালে তা অপরাধমূলক নরহত্যা হবে।
৩০০ ধারানুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে অপরাধমূলক নরহত্যাকে খুন বলা যাবে-
• মৃত্যু সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোন কাজ দ্বারা মৃত্যু ঘটালে। (যেমন- ক, খ কে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে মেরে ফেল, যা খুন)
• যে আঘাতের ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে, আঘাতকারী জেনে-বুঝে এমন আঘাত করে কাউকে মেরে ফেললে, সেটা খুন বলা যাবে। (যেমন- ‘ক’ একজন রোগী, একটিমাত্র আঘাতে তার মৃত্যু হতে পারে, ‘খ’ সেটা জেনে-বুঝে মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে এমন আঘাত করে ‘ক’ কে মেরে ফেলে। ‘খ’ খুন করেছে। যদি উক্ত আঘাত স্বাভাবিক মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট নয়)
• যে আঘাত কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট, এমন আঘাত দ্বারা কারো মৃত্যু ঘটালে। (যেমন- ক, খ কে তরবারি দিয়ে একটি কোপ দেয়, যা কোন ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। ক খুন করেছে)
• যদি কেউ জেনে-বুঝে এমন বিপদজনক কাজ করে, যা কারো মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। এমন কার্যসম্পাদনকারীর কাজের ফলে কারো মৃত্যু হলে (যেমন- বিনা কারণে ‘ক’ জনতার উপর গুলি করে, ফলে একজন লোক মারা যায়। ‘ক’ খুন করেছে, যদিও যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে তাকে হত্যার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না)
৩০০ ধারার যে ব্যতিক্রমগুলি থাকলে অপরাধজনক নরহত্যাকে খুন বলা যায় না-
১. গুরুতর ও আকস্মিক উত্তেজনার ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে। যেমন- ‘ক’ তার স্ত্রীর সাথে ‘গ’ কে যৌনকর্ম করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে ‘গ’ কে হত্যা করে। ‘ক’ অপরাধজনক নরহত্যা করেছে)
২. পূর্ব পরিকল্পনা ব্যতীত সরল বিশ্বাসে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগকালে অধিকার প্রয়োগের সীমা লঙ্ঘন করে কারো মৃত্যু ঘটালে। (যেমন- ক, খ কে চাবুক দিয়ে প্রহার করার চেষ্টা করে, খ পিস্তল বের করে তবুও ক প্রহার করার চেষ্টা করে। খ নিজেকে চাবুকের আঘাত থেকে রক্ষা করতে সরল বিশ্বাসে ক কে গুলি করে। ক মারা যায়। এটাকে খুন বলা যাবে না)
৩. সরকারী দায়িত্ব পালনকালে সরকারী কর্মচারী আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা অতিক্রম করে কারো মৃত্যু ঘটালে এবং সেখানে কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা না থাকলে।
৪. আকস্মিক বিবাদের সময় আকস্মিক উত্তেজনার কারণে মৃত্যু ঘটায়।
৫. যদি ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে।
Discussion about this post